সঞ্জয় আচার্য এর কবিতা

42

যে যুবতী আগে আগে চলে

ঘড়ির দোলন গতি মেপে মেপে
ছায়া তার অনুষ্ঠুপে দোলে
রাস্তায় যে যুবতী আগে আগে চলে।

এ যাবৎ জমে থাকা যত নদী স্রোত
ট্রিম করা চুলে তার ফুটে ওঠা ফুল
পীঠের বাগান ওড়ায় প্রতি পায়ে পায়ে
সফেদ অনন্ত ঢেউ ভেঙে ভেঙে আসে তার গায়ে।

রাস্তা যামিনী রায় লীলায়িত চরণের দাগ
কেউ নেই আর, সে আছে আগে আগে
পিছে পিছে চলে অনুরাগ।

ছায়া দেখি মায়া দেখি তখনও দেখিনি তার মুখ
উচ্ছন্ন বাতাস তবু কানে কানে বলে যায়
তোমার ভারী অসুখ
তোমার ভারী অসুখ।

০২
পায়েসন্ন

ব্রহ্মচারী নই, জ্যোতিষীও না
কি গণ রাশি জানতে চাই না।

এই মেঘলা দুপুরে বৃষ্টিপাত হোক
জনশূন্য লোকালয়,
পাত্রে সাজানো থাক পুনঃর্জাত ভাঙ্গন
সন্ধিস্থলের ।

এসো,
বৃক্ষের নিচে নিজেদের বিনিময় করে নিই

জাতকের গল্প হয়ে জন্মাক
এই সেবা…

০৩
মেঘ এল

আষাঢ় ঘনিয়ে এল,
মেঘ এল ওবাড়ি এবাড়ি ছেয়ে।

তাকে তো দেখছি না, সে এলো কই
উতলা আকাশে যে প্রথম এসেছিল
বর্ষার গান গেয়ে।

ও বজ্র, তুমি এত ভয় দেখাচ্ছ কেন?

ভয় পেয়ে সে যদি না আসে কোনোদিন
আমি কীভাবে কোন পথে শুধবো তার ঋণ?

০৪
ক্রৌঞ্চ হতে পারি

তবে তো আমিও ক্রৌঞ্চ পারি
দন্ডকাল,
অপূর্ণতার স্বাদ নিতে নিতে
যদি ব্যাধ এসে মাপে তো মাপুক
স্থির চোখে ছন্দ ও মিথুনের ডাল।

শুধু একটি আর্ত রবে অদূরের আশ্রম উঠুক জেগে
আর একটি মহাপর্বের গর্ভাধানে…

০৫
ছোঁয়া

বেশ গুছিয়ে নিয়েছি ভেবে
বসে যাবো দুদন্ড মাটির ওপর একদিন
সুস্থির সড়ক এসে জল দেবে পথের প্রান্তে আসন
ঝুলি থেকে মন্ত্রপুত জগৎ, সাবেকি বিকেলের
বিবাগী গান গেয়ে শতাব্দী ও পাড়ে যাবে।
গুছিয়ে নিয়েছি ভেবে
আমিও ছেড়ে দেব মুঠো থেকে ওকে।

এ পৃথিবীর সমস্ত কুঞ্জবন
সবুজ ঘাসের শরীর ফিরে পাবে
শিশিরের কণা তার শিরায় শিরায়,
অনাবৃষ্টির অজন্মা দুপুরের ছায়া পেয়ে
শীতল হবে ।
অবসাদ ভেঙে গুছিয়ে নিয়েছি ভেবেও
হঠাৎ সে বিহান বেলায় শিমুল কন্যার লাজুক গায়ে
হাত দিয়ে দেখবো শরীর পুড়ে যাচ্ছে
বসন্তের স্রোতে।

০৬
দাঁত ক্ষেত

এখানে নয় ,গতকালের লোকাল ট্রেনে
ফেলে আসা আধোনীল শাড়ি আর
বিতস্তা নদীর থই থই কোমরখানি।

মেঘের আড়ালে যে আরাধিকা নগর আছে
যেখানে জলপরীরা স্বজন ফুলের মালা গাঁথে
ওখানে…

ও মেঘ, আরও কিছুক্ষণ আড়াল রাখো
এ যানজট, এ ক্রসিং পেরিয়ে ঘামে ও রোদে
পাক খেতে খেতে ঝরে যাক রাষ্ট্র,

আমি আবার একবার গুছিয়ে গুছিয়ে ভেবে নিই
ওপাশের সিটে জ্যোৎস্না-পরি, সাদা দাঁত-ক্ষেত
আর মাইল মাইল কালো চোখের অতল দৃষ্টি।

০৭
মাটির পাণ্ডুলিপি ভোরের ট্রেনে

ভবিতব্যের হাটে
সম্ভাব্য যুবকমেঘ যেতে যেতে দেখে নিচ্ছে,
ধুলো ওড়া মোরামের সরান বেয়ে শিবুকাকা মাঠে যাচ্ছে
করিমের মাছের ঝাঁকায় এপাড়া ওপাড়া চুনোপুঁটি চাহিদা,
তাকে ঘিরে গোল হয়ে বসবে দর-কষাকষি সকাল কিছুক্ষণ পরে।

গতরাতে ফুটে থাকা কাঠকাঞ্চনগুলো মৃদু হাওয়ায় দুলছে
পরেশকাকার বারদরজায়।
একটু পরেই ও মুনিয়াকে আবভাবে বলবে–
আমার গ্রাম ছেড়ে শহরে যাওয়ার বিরহ-ধূসর কথা।

বুড়োবট ছায়া দিয়ে লিখে রাখবে সেসব পংক্তি,
কখনও খররোদ কখনও রাখালিয়া এসে
গুলিয়ে দেবে তার ছন্দ ও অন্ত্যমিল।

তারই মাঝখান দিয়ে গৃহস্থ উঠোন থেকে কলকল রবে
একপাল হাঁস ভাঁট-শালুকের ঠোঁট ছুঁয়ে দেখে নেবে–
কতটা সনেট হয়ে দূরে চলে যাচ্ছে মাটির পাণ্ডুলিপি
ভোরের ট্রেনে।

০৮
পোড়ো বাড়ি ও পদবি

জল আর জলতল, অন্ন আর অন্ন-পাত্রের মাঝে,
হলুদ ঘাসে ঢাকা দু একটি পোড়ো বাড়ি বাস করে।
এসব বাড়ির ভিতরে সোঁদা গন্ধ,মাকড়শা ও ঝুল
জমে জমে ক্রমশ ফুসফুস অপরিচিত, জমাট আকুল।
পরিযায়ী রোদ কখনো বা প্রলেপে হেসে যায়
তথাপি ঢোকে না তো আলো, জানলা ও দরজায়।
একই বৃত্ত
ছাউনি ও উঠোনের নিগড়ে নিমিত্ত,
ঘুরে ঘুরে পাক খায় গাঢ় অপব্যয়ে উপগ্রহের মতো।
উপগ্রহের কোনও সংসার হয় না তলদেশ হয়,
পোড়ো বাড়িরও তাই।
স্থবির কণ্ঠে দিনের পর রাত্রি হয় বেদনার,
রাত্রির পর ভাসমান দিন তার।
মাঝখানে,
সন্তর্পনে কিছু শক্তপোক্ত পদবি ঘোরে ঘরময়,
কোথাও কোনও হলুদ ঘাসে ঢাকা উঠোনের চারিধারে
মেঘ আর মেঘ ছায়া,পোশাক আর পোশাকির চরে
বিপজ্জনক এক আধটা পোড়ো বাড়ি বাস করে।

০৯
ইচ্ছে

যেটুকু পেয়েছি নিয়ে চলো
বাকিটুকু পড়ে থাক।

সুখেও জীর্ণ হাত, চিহ্ন লেগে আছে সূক্ষ্ম শিরায়
ধ্রুপদী আঙ্গিক যেটুকু—নিয়ে চলো
মাটিতে পড়ে থাক বাকি সব তৃষ্ণার্ত এভিনিউ।
ছাদের ওপর মেলে দেওয়া মেঘলা আকাশ
বাসরুটে অচেনা আলাপ,
এবার নীরব হও।

কোনো এক ইস্টিশনে এসো
হাতে হাত ধরো নাবাল সুমদ্র বুকে।

১০
নদীর দুপায়ে

নদীর দুপায়ে ঘুঙুর দাও ও নাচুক
নাচতে নাচতে চলে যাক
নুড়ি পাথর পেরিয়ে প্রান্তর পেরিয়ে
অনেক দূরে।

আমি উত্তরে হাওয়ার গানে আজ
যে সুর শুনতে চাইছি
তা শহরিয়া সিগনালে আটকে আছে
বাধ্যতার স্থিরে,কষ্টের কথামালায়।

যে কাহিনি কোলাহল ঢেউ,
আমার থেকে দূরে যাওয়া সে আবেগ
একবার ডাকুক দুপাড়ের ছন্দে ও তালে,
আমি উঁচু উঁচু দিনরাত আর
কড়া পাক সংলাপ ভেঙে ভেঙে
অবাধ্য ছুটে খুঁজে নেব
ও দুটি ঘুঙুর-পা গভীর আশ্লেষে।

১১
বীজ ধান

মেঘের নরম মাংস বেয়ে নেমে আসুক
মন্থনের শেষাংশ,
ইশারায় উর্বর হয়ে ওঠা পতিত ক্ষেত্র
তারপর নুয়ে পড়ুক হিসাবের ভারে।

কয় মাস এলো আর কয় মাস গেল
কতবার চাঁদ এসে দাঁড়ালো ওধারে,

চারার সুগন্ধি নিয়ে চাষি বউ ভাবে
অথৈ পৌষের মাঠে
সুপক্ব জ্যোৎস্না এসে বসেছে অপেক্ষায়।

১২
নিঃশর্ত

মায়াকাজলে মুছে যায় পরিচয়।

একটি ইচ্ছে তার পাখির ডানায়
আর একটি
পায়ে পায়ে স্রোত বুনে যায়।

এ রকম নিঃশর্ত ভালোবাসায়
অনেকটা পথ লেগে থাকে অনন্তের ইশারায়।

১৩
সংলাপ

বসুধা ও আমার সংলাপের মাঝে
কোনও কোলন, সেমিকোলন ছিল না
শুধু একটি নদী ছিল ডিঙি নৌকো অভাবী।
পাড়ে দাঁড়িয়ে এক কাল কমন্ডলু পূর্ণ করে চলে যেত
ভরা কোটাল আর মরা কোটালে আমার কন্ঠস্বর আচ্ছন্ন হলে
বসুধা তাকে ছুঁতে আসত। নদী বাড়িয়ে দিত বেগ,
দুপাড়ের অনবিচ্ছিন্ন কথা শুনতে শুনতে শুষ্ক হয়ে উঠত ত্বক।
সজল মেঘ ডাকত বসুধা। মেঘ আর শব্দের প্রতিবিম্ব স্নায়ুভূমিতে
কোলাহল চাষ করে ফিরে যেত ।
বসুধা তাকে বলত, তোমার সাথে দেখা হলে ভালো হত
সেই বৃষ্টিভেজা নীরবতায়
যেদিন টবের চারাটি সারারাত ধরে চেয়েছিল,
কাল সকালে একটি ফুল ফুটুক।