তন্ময় মণ্ডল-এর কবিতা

73

(০১)
শিকড়

প্রিয় নদীর জলে, চেনা ধানখেতের গুল্মলতায় কতদিন
এ-শরীরের ছায়া পড়েনি।
কত রাত আমাকে ছাড়াই বেজে গেছে গীর্জার ঘড়ি।
ঠাকুরদালানের গা বেয়ে যে নতুন লতানো গাছ
তারাও জানি ফিরে গেলে আড়চোখে দেখবে আমায়।

শৈশব লেগে আছে যে নদীর গর্ভগৃহে,
যে খেলার মাঠে আমার ছেলেবেলা ধুলো হয়ে মিশে আছে
তারা কি মনে রেখেছে এতকাল পরেও?

এ-শহরে মাঝে মাঝে
চোখ বুজে আজও শুনি
ঠাকুমার কীর্তন গান,
যে পাখি ফেরেনি ঘরে
তারও তো ডানায় থাকে
অস্ফুট শিকড়ের টান।

(০২)

রাত্রি থিতিয়ে পড়ার পর

খালি চোখে কত কী দেখা যায় না,
এই যেমন বিপন্নতা, অসহায়তা কিংবা
অতলান্ত সাগরের বুক চিরে চলে যাওয়া বিবাগী বাতাস।

বাড়িতে আলোর খনি আছে জেনেও যে মানুষ
বাড়ি ফেরার সময় পিছিয়ে দেয়
তাকে প্রশ্ন কোরো না।

কোনো নিস্তেজ কালো সন্ধ্যায় একটা টিমটিমে প্রদীপ জ্বালিয়ে
তার জন্য প্রার্থণা কোরো।

অসহায়তার শব্দ বড় ক্ষীণ।

বর্ষার দিনে কত বৃষ্টির ফোঁটা
মাটিতে মিশে যাবে জেনেও গাছের পাতায়
ইলেকট্রিকের তারে
পাঁচিলে-কার্নিশে ক্ষণিকের জীবন খুঁজে নেয়।

তারা চেনে অসহায়তার রেখাচিত্র।

বাড়িতে আলোর খনি আছে জেনেও যে মানুষ ফিরে আসে
রাত্রি থিতিয়ে পড়ার পর
তার প্রতি অভিমান রেখো না বুকের ভেতর।

(০৩)

ভার্চুয়াল

একঘরে আমরা তিন তিনটে লোক বসে আছি,
অথচ কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলছি না।

প্রত্যেকের দৃষ্টি আলাদা আলাদা আলো খুঁজে নিয়েছে, বাক্সবন্দী আলো।
যে আলোর অবচেতনে অচেনা ব্ল্যাকহোলের দরজায় অপেক্ষা করছে ভার্চুয়াল কাক।
তার ডানায় লেগে আছে নষ্ট সময়ের সুস্পষ্ট ছাই।

আসলে, সুদীর্ঘ ভার্চুয়াল মিছিলে আমরা একটা শষ্যদানা খুঁজছি প্রত্যেকে।
যে খোঁজ আরও একা করে দিচ্ছে আমাদের।

(০৪)
আলোর পেয়ালা

বালিশের গায়ে ঘুমের গন্ধ লেগে
আলস্য খুব ভোর-পাখিদের শিসে
দিন শুরুতে তোমার শব্দ এলে
রোদ খেলে যায় কার্নিশে-কার্নিশে।

তোমার কণ্ঠে সকাল শুনতে পেলে
রাতের ক্লান্তি আর যাবতীয় ক্ষতি,
সামলে নিয়েই দৃষ্টি এগিয়ে দিই
রক্তে ছোটে আগুনের প্রজাপতি।

কী মোহ তোমার সকাল-কন্ঠে জানো?
ক্ষত-বিক্ষত মানুষ ফেরে রাতে,
সকাল হলেই মাথার কাছে এসে
দাঁড়াও তুমি আলোর পেয়েলা হাতে।

(০৫)
মায়ার মানুষ

আমি তাকে চিনি।
না, চিনি বললে পাপ হবে, জানি।
সে এক মায়ার মানুষ।

শীত এলে তার পায়ের তলার মানচিত্র বদল হয়। আগুনে আগুনে ফোস্কা পড়া হাত। নখের কোনায় হলুদের দাগ বারোমাস। আঙুলের কাটা দাগগুলোকে সে ক্ষত বলতে ভুলে গেছে বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই। সবার খাওয়া শেষ। হাড়ির তলায় যতটুকু আস্বাদন তাতেই পরম তৃপ্তি। নিজের জন্য কক্ষণো কিছু চায়নি সে, চায়ওনা।

সম্পর্কের সুঁতো আঁকড়ে বেঁচে থাকা অভাগা মানুষের আড়ম্বড়ে আসক্তি থাকে না।
সে শুধু গোছাতে চায় ভেঙে যাওয়া মায়া-ইমারত।