সৌম্য সালেকের কবিতা

201

উত্তরাধিকার
ক.
পেছনে ফেলেছি রাত্রি, লক্ষ লক্ষ দিনান্ত প্রহর
সমুদ্র লহরী আর অমানিশা প্রত্নগুহার
আমার নেই কোনো দেশ সবিশেষ ঠিকানা-নিশানা।
আদিম ভ্রমণে যারা বন ছেড়ে এসেছিল পার হয়ে করাল হিমানী। যূথরথে পেরিয়ে এসেছে মরু, পথে পথে তুমুল তটিনী, পায়ে দলে পেরিয়ে এসেছে কাঁটা– যারা জলে-কর্দমে একাকার নেমেছিল হারপুন হাতে এই তৃণদলে, এই জলাঞ্চলে–
আমি সেই শ্রান্ত অভিবাসীদের উত্তরাধিকার!

খ.
মাতৃজঠর থেকে উত্তোলন করে একটি ফুল তোলা কোমল কাঁথা জড়িয়ে প্রভাতে সূর্যের প্রতি ইশারা করেছে যে আমার আগমন, আমি তার কাছে ঋণী! সেইসব আদি নরনারী যাদের নিশিডাক শুনে পালাতো পশুরা।
যাদের হাড় মিশে আছে পুরনো পাহাড়ের তলে- কঠিন শিলায়!
শিকারের কালে ক্ষিপ্রবেগে পাথরে পাথরে যারা ছড়িয়ে যেতো অগ্নিপুলক; আলোহীন শ্বাপদ-শঙ্কুল রাতে ভোলেনি যারা সন্ততির কথা সেইসব সহৃদয় প্রবীণের কাছে আমি ঋণী!
ঋণী আমি পিতৃপুরুষের কাছে যে রক্তধারা বইছে শিরায়
ঋণী আমি শস্যক্ষেত, নদনদী আর শত সহ্যশীল রমণীর কাছে–
চিরঋণী আমি, এই জল এই মাটি মাতৃকার কাছে।
**

02

কালো মায়ের গল্প

বাবা বকাঝকা করছেন, আমরা ভয়ে জড়সড় দুইভাই দাঁড়িয়ে আছি মার পাশে
ভুল শুধরে দিবো কিংবা প্রতিবাদে আঙুল উড়াবো তেমন বয়স আমাদের ছিলো না
তাই নির্বিকার আমরা এরকম বহুবার মায়ের কালো গাল বেয়ে অশ্রু গড়াতে দেখেছি

রোজ তিন বেলা আমরা রাঁধতে দেখেছি মাকে কিন্তু হালিমের মা’র মতো সাজতে দেখিনি কখনো অলঙ্কার কিংবা অনাদৃত পালকের এসব আচ্ছাদন স্পর্শ করেনি জননীর কৃষ্ণমুখ

বাবা বাইরে বেরুতেন আর তিনি চুপচাপ পিছু নিয়ে কাচারি ঘর পর্যন্ত এগিয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেন তারপর সারাদিন অস্থিরতা, অপেক্ষার দীর্ঘশ্বাস

মা কালো কীভাবে বাবার মন ভলো থাকবে তাই আমরা কৈশোরেই প্রৌঢ় হয়ে উঠি
আরও শান্ত হতে শিখি
আর আমাদের মা ছিলেন মাটি…

**

০৩

বীক্ষণ

অবিরাম ধান কেটেছি গত ঘুমে, কাস্তে ছিল ঘামের জোয়ার
অবিরাম মাছ ধরেছি গত ঘুমে, জাল ছিল নিশ্ছিদ্র তৃষার

অবিরাম পুড়েছে জীবন গত ঘুমে, অসহ রাতের শরম অবিরাম বীজ বুনেছি গত ঘুমে, মাটি ছিল নারীর নরম

অবিরাম হেঁটেছি শ্রমণ গত ঘুমে, মন ছিল মত্ত শ্রবণে
অবিরাম গেয়েছি গান গত ঘুমে, বেহুলার অশ্রু শ্রাবণে

আরও অবিরাম, অবিরাম কেটেছে প্রহর কত অনুভবে জেনে যাই আমি
তবু গানে ও গমনে বুঝি না জীবনে চাষ করি কার জমি…

**

০৪

স্বপ্নিল সন্ন্যাসে

ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবো আমি
নিজের আড়ালে চুপ
কোথাও যাবো না আর
প্রেমের জন্য রমনীর কাছে না
যাবো না সুবাসের খোঁজে বনপুষ্পলোকে
সুর খোঁজে রাখালের পিছে না
যাবো না বাতাসের টানে সাগরে

আমি আর কোথাও যাবো না
কোথাও যাবো না আমি
আমার হৃদয়ে প্রেম ফাল্গুন মধুমাস
আমার হৃদয়ে চির উৎসব সুধা-রাস
কেউ এসে খুলবে বুকের খিল
ভাঙবে মোহন জটা
তার সাথে গান হবে, হবে চিন-পরিচয়
জেগে আছি পথ চেয়ে আমি তার স্বপ্নিল সন্ন্যাসে…

**
০৫

মাতৃহারার জন্য

কেউ তার দুঃখ ভোলাতে পারবে না
না আকাশ, না শ্রাবণের মেঘমালা
না সাগর, না ঈশানের স্বর্ণ-প্রভাতি

কেউ তার বেদনা ঘোচাতে পারবে না
না পাহাড়, না স্বজনের সজল-প্রবোধ
না বাতাস, না পাখিদের নীরব-নিশুতি :

যে তার মা’কে দেখেছে খাটে, মানুষের কাঁধে—
শ্মশান বা কবরের অভিমুখে…

**

০৬

আমি জানি আমার কবিতা

আমি জানি এসব কাব্যকাহন শুনবে না লোকে
গীতরূপে কণ্ঠে পাবে না ঠাঁই,
কারো নিবিড় পঠনে হবে না উদ্ধার
ছেঁড়াখোঁড়া অক্ষরে মেশা এসব অতিইচ্ছার আহাজারি
আমি জানি, বহুদিনের জমে থাকা ধুলা ঝেড়ে
এসব স্বপ্নকথনে উঠবে না মেতে নতুন যুগের কেউ
পুরনো কাগজের সাথে বাহারি কথারা-সব ভাঙ্গারি দোকানির স্তূপে
একদিন সকরুণ ভিজবে-শুকোবে!
কিংবা ঝালমুড়িওয়ালার ঠোঙ্গা পড়বে কোনও যুবকের হাতে–
সে একবার তাকাবে না ফিরে কী-লেখা সেখানে!

জীবনের আরও যত অপচয় আছে
তার সাথে গভীর মিতালী করে
তার-ছেঁড়া গান করে আমার কবিতার কথা!
অভিমুখ-অভিলক্ষ্য নেই এমন কিছু পাখি আছে বনের বিজনে একমনে গান গায়–
কে শুনে তা, ফুল না জলের মাছ, দেখে না কখনও
সেসব পাখিদের দলে আছি আর-সব ফুলের উদ্ভাসে
আমি জানি, ভোলা রাখালের বাঁশি যে সুর বাতাসে ছাড়ে, মানুষের হাটে সে বিকোবে না কোনোদিন।