০১
কোপাই নদীর তীরে
কোপাই নদীর তীরে–
সময় এখন খুব নতজানু,
সবুজ কস্তার বনে
হেঁটে যেতে যেতে শুনি
এ কিসের সংকেত?
যেন উন্মুক্ত রাতের
শিস তুলে নাচছে
উন্মাদ প্রেমিক কৃষ্ণ!
আর শ্যামলা মেয়ের গলায়
সোনার হাঁসুলি দুলে দুলে তুলছে,
দীর্ঘ জোয়ারের মতো
সারি সারি স্বচ্ছ ঢেউ!
স্মৃতির দেয়াল ঠেলে
নিয়ে আসে
অস্পষ্ট বিষাদ…
ধোঁয়া ধোঁয়া চোখে দেখি
ছায়াপথের মতো আদিম
অইথই করা গঙ্গা-যমুনার ধারা,
হাজার ফনায় ঢুলছে মনসা;
লবঙ্গফুলের
আকসি গন্ধে
কেঁপে কেঁপে ওঠে বুক!
আবারও সবকিছু
ভুলে যাওয়ার আগে
তবে মুহূর্তগুলোকে এবার
ধরে রাখি হাতের মুঠোয়।
০২
দূরত্ব
রাতের ভেতর ডুবে যেতে যেতে
অঘোরে ঘুমিয়ে আছি
আর কোনো দুঃখ নেই অথবা দুঃখের অনুভব
উজ্জ্বল আকাশ দেখে দেখে চোখ ব্যথা হলে
আদিম মাটির স্পর্শ মনে পড়ে,
হারিয়ে ফেলেছি সেই চিরচেনা পৃথিবীটা যেখানে যুদ্ধ ও ছলনায় বুঁদ হয়ে থেকেছি আমরা অন্ধের উল্লাস নিয়ে চোখেমুখে;
আত্মার অসুখে ইতিহাস কালো হয়ে গেলে দূর এক রাত্রির গহ্বর থেকে
মাতাল ইশারা আসে,জ্বরে ভুগে ভুগে অভিমানী মানুষেরা মৃতদের হাত ধরে চলে যায় সূর্যাস্তের দিকে;
কোলাহলহীন কোনো বিস্মৃতির পথে, শীতকাল চলে গেছে সেই তো কবেই
বাতাসে ভাসছে ঝরাপাতার এস্রাজ বিষাদের মেঘ; সে তো নয় মানুষের অন্য কোনো ঘ্রাণ!
কাফনের বিচিত্র পোশাকে ঢেকে থাকা স্পর্শহীন দেহে দীর্ঘ বিষাদে, প্রলুব্ধ বিরতির পর কোথাও কোথাও ভোর দেখা দিলে সময়ের সঙ্গে শুধু
দূরত্ব রচনা করে চোখ
আর ধরণীর বুকে খুব চেনা শীতলতা নেমে আসে ধীর পায়ে…
০৩
নৈঃশব্দ্য দেয়াল
ধুপছায়াগন্ধ্যা কোনো দিনে
দূরে মৌন আকাশের মহিমায়
কৃষ্ণ সপ্তমীর চাঁদ উঠছে পূর্ণ হয়ে…
.
এখন ঘরের আগুনে পুড়ে ছাই
বিশ্বাস আর কার্তুজ জীবন
.
সভ্যতার বিস্ফোরণে অসুর পৃথিবী
অথচ প্রাচীন মাটির ওপর দিয়ে
হেঁটে চলেছে পিঁপড়াদের
দুইটি বিপন্ন মিছিল!
.
কিছু কিছু পিঁপড়া মিছিলের
নিয়ম ভেঙেছে
ক্লান্ত পায়ে ভেঙে দিচ্ছে শাসনের ঘোর
যখন তখন ওরা জড়াজড়ি করে
চুমু খাচ্ছে একে অন্যকে
কী করে সম্ভব?
অথচ দেখেছি আমি
পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে থেকে,
হেঁটে, বসে কিংবা শুয়েও
মানুষ কী করে ক্রমাগত
নিজেদের ভেতর নিঃশব্দে
দেয়াল তুলে দেয়।
০৪
কালো পুতুল
সাজঘরে সঙ সেজে বসে আছে একটি কালোপুতুল
মসৃণ ঝলমলে আলোর স্টেজে
ম্যাজিক দেখাবে সে নেচেনেচে, দুলেদুলে
কাঠের পায়ের পাতায় ঘুরেঘুরে,
আটকে যাবে অজস্র আনাড়ি
লোকের দৃষ্টির ঘোরে!
অথচ এখন বহুদুরে স্থির হয়ে ঝুলে আছে
তার দুচোখের মনি…
শীতের শেষ ভোরে পুঁই পাতার উপর
মায়ার ফোড়ন ছড়ায় মিষ্টি রোদের ঝাঁজ আর
বাদামপাতার ছায়ায় অবিকল বিষণ্ণ বালিকার মতো বসে থাকে একটি রাজহাঁস;
পুকুরপাড়ের পুরাতন বটের বাকলে ফাটল লেগেছে
সেখানে সবুজ শ্যাওলা ছড়িয়েছে তার ঘন আঁচল,
মধ্যরাতে সরলরেখার নির্জনে মিশে গেছে
নাম না জানা নদীটি
হু হু বেদনার হাওয়া দুলে দুলে ওঠে বুকে!
সন্ধ্যাবাতি নিভে যেতেই
পুতুলটি নিখোঁজ হয়
পিছন দিকের আঁধারঘন বনটির বুকে…
০৫
হঠাৎ বৃষ্টিতে একদিন
হয়তো কোনো একদিন তোমার সাথে,
কোনো এক গোধূলিবেলায় কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে যাবে।
হয়তো সেদিন এই বিষণ্ণ শহরে
সারাদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়বে, কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় চারদিক শুনশান!
আমি অভিমানে ভিজে ভিজে
তবু শুধু তোমার দিকেই হেঁটে যেতে চাইবো বারবার…
তোমার হয়তো ঠান্ডার বাতিক আছে
কোনো এক অচেনা বাড়ির সামনে গিয়ে
এমনই আশ্চর্য আড়ালে হারিয়ে যাবে, যেন
গায়ের কোথাও একটুও বৃষ্টির ছাঁচ না লাগে।
দীর্ঘশ্বাসের মতোই লুকিয়ে পড়বে সময়ের দূরত্বের ভেতর
তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে আমি তখন দূর্বাঘাস!
লতায় পাতায় এলানো ধুলোকণা।
উদ্বাস্তু হৃদয় নিয়ে,
হঠাৎ থমকে গিয়ে আমি অতীত স্মৃতির মতো
দ্বারে দ্বারে নিভৃতে আঘাত করে যাবো
চেনা দৃশ্য থেকে ছিটকে পড়ে
নির্দয় বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে শোকে বিহ্বল
অচেনা ভিখারির মতোই ছলছল চোখে
মাথা নিচু করে রইবো প্রার্থনারত…
০৬
ঝুঁকি
পেঁয়াজের খোসার পরতে পরতে শুধুই অপেক্ষার জলবায়ু জমে থাকে
.
আলোর ক্যানভাসে স্বপ্নছবি আঁকবো বলে, একটি অবলুপ্ত গল্পে নিজেকে লিখছি অবিরাম ডটে…
.
পুরনো তারের জঙধরা সুরে জেব্রাক্রসিং টানা আছে আমাদের জীবনরেখায়!
.
দুজনেই জানি খুব ঝুঁকিতে রয়েছি।
.
তবু ভীষণ অসুখে ভুগে ভুগে সেই ব্যথাতুর ক্যানভাসে এঁকে গেছি অজস্র বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা ফুল…