০১
ফুলচাষি মালি যাই বলো

গর্ভেই টের পেয়েছি চারপাশে হিংস্র দুর্গন্ধ।
আর ফুল চাষের ট্রেনিং পেয়েছি তো
সেই গর্ভেই।

পৃথিবীতে ফুল চাষাবাদ করে টিকে আছি ভাই।
ফুলচাষি মালি যাই বলো-
আমার কোন অসুবিধা নাই।

০২
জেলে

আমার মায়ের নাম গ্রাম।
পিতা নাকি দূরের শহর!
নদী আর খাল দুটি বোন,
হাওর-বাওড় সহোদর।

আমি ভালবাসি সমুদ্র-দুহিতারে—
দিগন্তের হাওয়া এসে শোনায় সুদূরতা,
মেঘের ঠিকানা, ঝড়ের বার্তাদি।

পিতা ভুলে গেছে আমাদের—
চুপি-চুপি কাঁদে মা আমার।
আমি তো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জেলে,
ফেঁসে গেছি জলচক্রে, জালে—
ফেঁসে গেছি রক্ত-মাংসের কঙ্কালে।

হে জল হে প্রাচীন ধারা—
ক্ষমো এই জন্ম এই মৃত্যু,
তোমার কাছেই সত্য আমার
মৎস ধ্রুবতারা।

০৩
কানামাছি

“আয় রে আমার
মগড়া নদীর শুশুক,
নাগড়া-মাঠের হাওয়া,
আখড়ার কীর্তন,
বারুনীর মেলা।

আয় রে আমার
মালজোড়া গানের আসর,
বাবা শাহ সুলতান-ওরসের জিকির,
আড়ংয়ের লাল ষাঁড়,
ভোরে ঘুম-ভাঙানি সা-রে-গা-মা।

আয় রে আমার
বকুলতলা,
ফুলে ফুলে বিছানো পথ।
আমার চোখের বাঁধন খুলে দেও…
এত এঁটে গিঁট দিল কে রে…।”

০৪
নদীতীরে বসে থাকি

মা সারাক্ষণ ভেবেছে—
নদীতে নিখোঁজ আমার বাবা ও ছোট বোনটি ফিরে আসবে,
থালায় ভাত বেড়ে বসে থেকেছে—
তারা ফিরে আসবে।

মা অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর—
লাঠি ঠুকে ঠুকে নদীতীরে গিয়ে বসে থেকেছে—
তারা ফিরে আসবে।

মা চলে যাওয়ার পর—
একদিন তার কবরও নদীতে চলে যায়।
আজ আমি নদীতীরে বসে থাকি—
নদী ডাকে, আয়… আয়… আয়…।

০৫
কবি ও খুনি

তোমার হাতের রেখা এত হিজিবিজি কেন?
এত অস্থির কেন তুমি?
বারবার হারিয়ে যাও, বারবার ফিরে আসো- আর
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ো!
নিহত হওয়ার চেয়ে খুনি হওয়া ভালো জেনে
খুনের প্রকল্প মাথায় নিয়ে সারাবেলা কোথায় ঘোরো তুমি?
শুধু বিধ্বস্ত ভোরের চিৎকার
আমাকে সূর্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে রাখে-
এমনই তোমার স্বার্থপরতা, হে প্রিয়।

আমি সারা রাত ঘুমোতে পারি না-
শুধু অস্ত্রে শাণ দেওয়া শুনি।

০৬
পৃথিবী

বাহ্! পৃথিবীটা দেখছি একেবারে নবীনা
এর নদীতে ডুব দেওয়া ভালো।
এরকম সচ্ছল নদীর ছলচ্ছলে
মনপবনের নাও ভাসিয়ে দেওয়া মন্দ নয়।
বাইসন ম্যামথের পেছনে ছুটতে ছুটতে
একদিন এরকম একটি পৃথিবীর সঙ্গে
দেখা হয়েছিল,
তার কথা মনে পড়ে।

আমি প্রতিদিন নতুন নতুন পৃথিবীর
সাক্ষাৎ পেতে ভালোবাসি।
আমি জানি অতীত মানে পুরনো নয়;
সে প্রতিদিন অষ্টাদশী রমণী, প্রতিদিন
বিবাহবার্ষিকী, প্রতিদিন দাঁত ব্রাশ করা।

পৃথিবী রজঃস্বলা চিরকাল,
আমি এর সঙ্গে খেলা করব এখন।

০৭
সাম্প্রদায়িক

পৃথিবীতে মানুষ আসলে বেশিদূর এগোয়নি।
মানুষ তো আজো সাম্প্রদায়িক রয়ে গেল।

আমার হিন্দু বন্ধুরা স্বপ্নে আজো শুধু কালিমূর্তি দেখে,
মুসলমান বন্ধুরা গরুর হাড্ডি দেখে।

আমি তো সবার জন্য কবিতা লিখতে লিখতে
ফতুর হয়ে গেছি—
সামাজিকেরা আমাকে একঘরে করে রেখেছে।

০৮
মদন সরকার

বাংলার শেষ কবিয়াল মদন সরকার কুঁজো হতে হতে
চাকা হয়ে গেছেন।
এখন তিনি কারো মুখ দেখতে পান না—
শুধু পা দেখেন আর মাটি দেখেন,
মাটিকে দিগন্ত ভেবে ভ্রম করেন।
ডাক পেলে এ বয়সেও মাইল মাইল
গড়িয়ে গিয়ে মঞ্চে ওঠেন, আসর মাতান।

এখন বাংলা স্টেশনে রেললাইনের পাশে
ঠাটা রোদের মধ্যে হাতুড়ি পেটাচ্ছেন মদন সরকার।
তার অসমর্থ হাতে পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ হাতুড়ি।
তার কাছে নিচু এলাকার নিচু ঘরদোরের মানুষজন আসে।
জংধরা প্রায়-বাতিল কুপিবাতি, হারিকেন, মগ,
লোটার অসুখ সারাতে আসে তারা।
মদন সরকার হারিকেনে পানি ভরে
খালি চোখেই নিশ্চিত হচ্ছেন
কোথায় ছিদ্র, ফুটো।
ছিদ্রের ওপর সিসা বসিয়ে টুকটুক করে
হাতুড়ি পেটাচ্ছেন তিনি,
নিচু মানুষের নিচু ঘরদোরের অন্ধতা সারাচ্ছেন।