নির্নলেন্দু গুণ : কথামৃত

142


আমি চালের আড়তকে নারীর নগ্নতা বলে ভ্রম করি।
নারীর মৃত্যু ছাড়া কোনো মৃত্যু স্পর্শ করে না।
যখন অগ্নির গ্রাসে এক-একটি সংসার পুড়ে ছারখার হয়ে যায়– আমি সে ভস্মস্তূপের মধ্যে ঝলসে যাওয়া শিশুর নিষ্পাপ মুখ, কিংবা সংসারের বিপুল বিনাশ দেখে আজকাল আঁতকে উঠি না।

শুধুই নারীর মৃত্যু সারক্ষণ জুড়ে থাকে আমার হৃদয়।
√√√

এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব? পাচ্ছো না?
একটু দাঁড়াও আমি তৈরি হয়ে নিই।
এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব? পাচ্ছো না?
√√√

অইখানে থাকে প্রেম, থাকে স্মৃতি, থাকে সুখ, প্রেমের সিম্ফনি–
অই বুকে প্রেম ছিল, স্মৃতি ছিল, সব ছিল, তুমিই থাকো নি।
√√√

ক্যামেলিয়া, তুমিও কি ব্যর্থ প্রেম? তুমিও কি প্রেমের সীমার?
√√√

ঐ যে ছায়ার মতো একটি মানুষ পথ হাঁটে, তাকে চেনো?

হাজার বছর নয়, এ-শহরে একযুগ কেটেছে তাহার।
তাকে চেনো?
ঐ যে ছ’ফুট দীর্ঘ সীমাহীন অসীম আগুন।

তাকে চেনো?
মাতৃহীন যে-যুবক রাত্রি এলে গণিকার স্তন্য চুষে খায়?
√√

আমাকে আসতে দেখে রেস্তোঁরার যেকোনো বেয়ারা এখন সানন্দে আদাব ঠোকে-, সোল্লাসে স্বাগত জানায় আপাতত তরুণ বন্ধুরা।
আমি টাকা ধার দিই অনায়াসে। গাছ-পাখি-ফুল-নদী,
আমি কারও কাছে ঋণী নই।

আমার বন্ধুরা বিব্রত করে।
আমি বিরক্ত হয়ে টেলিফোনে জনৈক মন্ত্রীর সাথে কথা বলি।
তারা খুশি হয়–।

যেকোনো পুস্তক প্রকাশক এখন আমার কৃপাপ্রার্থী, যেকোনো মস্তান এখন আমার মন্ত্রমুগ্ধ, একান্ত অনুগত, বাধ্য বশংবদ।

√√√
সাপের ফণায় নয়, রমণীর স্তনাগ্রচূড়ায় স্থির আমার পৃথিবী, অর্থাৎ সমস্ত পৃথিবী।

আমি সেই পৃথিবীকে প্রতিদিন কুরে-কুরে খাই, খুঁটে-খুঁটে খাই–
অর্থাৎ আমাকেই খাই।
√√√√

মাননীয় সভাপতি ……।
সভাপতি কে? কে সভাপতি?
ক্ষমা করবেন সভাপতি সাহেব,
আপনাকে আমি সভাপতি মানি না।
√√√√

মুহূর্তেই সে-মানুষ রক্তের শাড়ি পরে হয়ে ওঠে আকাঙ্খিতা নারী,
পয়েতে ঘুঙুর বাঁধা, খোঁপায় অজস্র পাখি–, বাঁকানো বাহুর বৃত্তে নৃত্য করে কাঁপায় আমাকে।
আমি তার মৃতদেহ সযত্নে টাকার মতো
বেদনার বাক্সে তুলে রাখি।
√√√

তোমরা যারা হারিয়ে গেছো, তাদের হাড়ে বোনা
বাংলাদেশে বৃষ্টি হলে আগুন হবে,
রোদ উঠলেই সোনা।
√√√

রেললাইন তৈরি হচ্ছে দ্রুত,
বিস্ফোরণে উড়ে-যাওয়া পুল আবার নদীর পাড় বেঁধে দিলে
বেনাপোল-বনগাঁ হয়ে হুশ হুশ ইঞ্জিন ছুটবে দ্রুত।

নদীর জলের মধ্যে, দুরন্ত পদ্মায় আমাদের উল্টো ছায়া নাম ধরে ডেকে নেবে কাছে।
যে-পথে এসেছিলাম সে-পথেই ফেরা।
√√√

চোখের গোলকে নয়, রক্তের ভিতরে টের পাই।
তোলপাড় করে ওঠে পুকুরের বন্দী তেলাপিয়া।
ছলাৎ ছলাৎ শব্দে পুকুরের পাড় ভেঙে পড়ে।
রাতের গর্জন ছুঁয়ে জেগে ওঠে দিনের মোহনা।
√√√

তারপর রাত্রি শেষ হলে
ব্যাকুলবাসনাস্রোতে
ভেসে গেছে সদ্যমৃত লতা,
খন্ড-খন্ড তৃণের জাগৃতি।
অক্ষম শব্দের চোখে চুমু দিয়ে
জাগাতে চেয়েছি তাকে ফের–
ছুঁয়ে ছুঁয়ে, স্পর্শ করে,
আঙুলের অদেখা খেলায়।

বীণায় জাগেনি সুর, অবেলায়
ভেঙেছে শিশুর ঘুমঘোর।
দীর্ঘশ্বাস লেগেছে দেয়ালে,
জেগেছো শব্দের প্রাণে–
প্রেম হয়ে, সুর হয়ে–
মুগ্ধমৃত তৃণের কঙ্কালে।
√√√

তুমি ছিলে শব্দবন্দী হলুদ কাগজে লেখা
একটি সামান্য চিরকুটে।

চঞ্চুপুটে সেই চিঠি নিয়ে
একদিন উড়ে যাবো তোমার ওখানে, যদি পাখি হই।

তুমি শুধু ভালোবেসে একটি ডলার দিও অতিথিকে, আর কিছু নয়।
√√√

এই পৃথিবীর নিরিবিলিগুলি,
পদতলে মাখা শেষ ধূলিগুলি
আজ বুঝি এই তাপস কবির
কিছুটা হইল চেনা।

সবুজ পাতার আড়ালে যে পাখি
প্রাণের শাখায় উঠেছিল ডাকি,
আজ বুঝি তার একটি পালক
লভিল বনের রাখাল বালক।
একটি চুমোয় শেষ হলো আজ
হাজার চুমোর দেনা।
√√√

তোমার সামান্য জয় পেয়েছে ক্ষয়ের স্পর্শ প্রতিদিন।
গগনউড্ডীনস্বপ্ন ডানাহীন জর্জরিত বিষে ঝরিয়েছে আহত পালক।
তোমার বালক তবু খাগেদুধেবিল্বপত্রে মিশে তিনটি পাতার বুকে ক্ষমাহীন উজ্জ্বল অক্ষরে লিখেছে তোমার নাম।
হে কবি, হে সম্পন্ন সাধক, তোমাকে প্রণাম।
√√√

এই যে শব্দ আজ সর্বোচ্চ বিভায় জ্বলে উঠতে চায়,
এই যে বাক্য আজ দৈবাগ্নিতে স্বপ্নের উদ্যান হয়ে ওঠে–
আমি তা চাইনি, আমি চাইনি কখনও।
√√√