ক্রুর হাসি | নুসরাত সুলতানা

130

নিবেদিতা মন্ত্রমুগ্ধের মত আবৃতি টা শুনলো একটা অনলাইন সাহিত্য গ্রুপে। প্রাঞ্জলের আবৃতি তাঁকে খুবই টানে। অনেক দিন থেকেই নিবেদিতা প্রাঞ্জলের আবৃতির গুনমুগ্ধ ভক্ত। প্রশংসাও করে সবসময়।
প্রাঞ্জলও নিবেদিতার লেখার প্রশংসা করে। নিবেদিতা একজন কবি ও একটা প্রাইভেট কলেজে ইতিহাস পড়ায়। প্রাঞ্জল একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার।
গ্রুপে পরিচয় হলেও দুজন এখন ফেসবুক বন্ধু। ইনবক্সে তাঁরা তাদের ভাবনা বিনিময় করে প্রায়শই। কিন্তু কারোরই প্রোফাইলে নিজের কোনো ছবি নেই।

দুজনের বন্ধুত্ব বেশ ভালো ভাবেই এগিয়ে যায়। প্রতিদিনই কথা হয় প্রাঞ্জল আর নিবেদিতার। কথা বলতে বলতেই দুজন দুজনের সম্পর্কে অনেক কিছু অবগত হয়। প্রাঞ্জল রাজশাহী ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজি থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এ পাশ করে একটা ব্যাংকের প্রধান আইটি কর্মকর্তা। নিবেদিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে সম্মান ও এম. এ পাশ করে একটা বেসরকারি কলেজে ইতিহাসের প্রভাষক।

নিবেদিতার বয়স ৩৫ আর প্রাঞ্জলের বয়স ৩৭। দুজনেই অবিবাহিত। দুজনের সবকিছু নিয়েই কথা হয়। প্রিয় কবি, প্রিয় সিনেমা, মা বাবা, পরিবার সবকিছু নিয়েই। কথায় কথায় প্রাঞ্জল জানতে পারে নিবেদিতার ছোটবোন নীরুর বিয়ে হয়ে গেছে তার একটা ছেলে আছে যার বয়স দুই বছর। বোনের ছেলে নিবেদিতাকে আম্মু ডাকে। বোনের ছেলের ছবিই নিবেদিতার প্রোফাইল পিকচারে দেয়া। আর প্রাঞ্জলের ছোট একটা বোন আছে তার মেয়ের ছবি প্রাঞ্জলের আইডিতে দেয়া।

নিবেদিতা আর প্রাঞ্জল নিজেদের পরিবারেও তাদের কথা হওয়ার বিষয় টা জানায়। নিবেদিতার বাবা মা সবকিছু জেনে খুশিই হয়। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, আবৃতি করে যদি মেয়েটার একটা গতি হয়। বিশেষ করে ছোট মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবার পরে নিবেদিতার বিয়ে তাদের বুকের ভেতর এক গভীর দীর্ঘশ্বাস!

প্রাঞ্জলের বিয়ে নিয়েও বাবা মার অনেক চিন্তা। সবদিক থেকে যোগ্য একটা কারণেই ভালো পাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। প্রাঞ্জল ওর শিক্ষা, রুচিবোধের সাথে যায় না এমন মেয়েকে বিয়ে করবে না।

প্রথমে প্রাঞ্জল ই নিবেদিতা কে বলে আমি তোমাকে দেখতে চাই। তোমার একটা ছবি দাও। নিবেদিতা বলে না। দেখলে আর ভালো লাগবে না। প্রাঞ্জল বলে আমি তোমার শিক্ষা, রুচিবোধ, মূল্যবোধ সব চিনেছি তাহলে আর কি চেনার বাকি আছে? বাহ্যিক অবয়ব দিয়ে কি মানুষ মানুষ কে চেনে? আর তোমার সাথে আমার সম্পর্ক কি আত্মিক নাকি বাহ্যিক!

নিবেদিতার ডাগর চোখ আর সহজ সুন্দর হাসি প্রাঞ্জলের মন কাড়ে। নিবেদিতার কণ্ঠ বেশ আদুরে আহ্লাদী। কিন্তু নিবেদিতা একটু মোটা। আর গায়ের রঙ বেশ চাপা। প্রাঞ্জল নিবেদিতার চোখ, হাসি আর কন্ঠের বেশ প্রশংসা করে। নিবেদিতা আত্মবিশ্বাস ফিরে পায় প্রাঞ্জলের কথায়।

এইবার নিবেদিতাও প্রাঞ্জলের কাছে ছবি চায়। কিন্তু প্রাঞ্জল বলে কি দরকার ছবি দিয়ে? নিবেদিতা বলে, নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে কি কারও দেখতে ইচ্ছা হতে পারে না? প্রাঞ্জল নিবেদিতা কে বলে, ছবি দেবো তবে কিছু শর্ত আছে। নিবেদিতা জানতে চায়, কি শর্ত? প্রাঞ্জল বলে, আমাদের ভেতরে যা কিছুই হোক বন্ধুত্ব যেন ভেঙে না যায়। নিবেদিতা স্মিত হেসে বলে আচ্ছা। সেটা কি আমিও চাই?

প্রাঞ্জল বসে আছে অফিসের ডেস্কে এমন একটা ছবি দেয়। প্রাঞ্জলের ব্যাক্তিত্বপূর্ন চেহারা নিবেদিতাকে মুগ্ধ করে। ধীরে ধীরে নিবেদিতার বাবা, মা মেয়ের বিয়ের স্বপ্ন দেখে। তাঁরা প্রাঞ্জল কে তাঁদের বাসায় ডাকতে বলে। নিবেদিতা বলে, বলে দেখবে। প্রাঞ্জল কে বললে, প্রাঞ্জল জানায়; আমাদের কোনোদিন দেখা হবে না। নিবেদিতা মন খুব খারাপ করে শুধায় কেন? প্রাঞ্জল সরাসরি বলে, আমি চাই না তাই। নিবেদিতা এ রহস্যের মানে বুঝতে পারে না। শুধু ভাবে এ প্রাঞ্জলের কেমন ইচ্ছা? কোথায় তাঁর সংশয়!

আপাতত নিবেদতা প্রাঞ্জলের সাথে বন্ধুত্ব, ছবি দেখা এসব কিছু নিয়ে খুশী। পরিবারের সবাই মিলে সাজেক ভ্যালি বেড়াতে যায়। যাবার আগে প্রাঞ্জলের কাছ থেকে নাম্বার চেয়ে নেয়।

চারদিনে বোনের স্বামীর রবি নাম্বার থেকে দুইবার কথা হয়েছে। কারণ সাজেকে অন্যকোন নেটওয়ার্ক কাজ করে না। এবার দুজনেই বুঝে যায়, বিষয় টা আর সহজ নেই। কোথাও বাঁধা পড়ে গেছে দুজনের মন।

এইবার দুজনে প্রতিদিন প্রায় ঘন্টায় ঘন্টায় ফোনে কথা বলে। সারাক্ষণ একজন অন্যজনের সংস্পর্শে থাকে ফোনে, মেসেঞ্জারে। হঠাৎ অসুস্থ হয় নিবেদিতা। বেশ জ্বর, সর্দিকাশি, ঠান্ডা ইত্যাদি। নিবেদিতা খুব আশা করে প্রাঞ্জল তাকে দেখতে আসবে। প্রাঞ্জলেরও খুব ইচ্ছা হয়। কিন্তু না এ যে অসম্ভব। সে নিবেদিতাকে হারাতে চায় না! প্রাঞ্জল পাঠাও ফুডে অর্ডার করে অনেক খাবার পাঠিয়ে দেয় নিবেদিতা কে। নিবেদতা শুধু জানতে চায়, তার সামনে আসতে কি সমস্যা প্রাঞ্জলের? প্রাঞ্জল বলে বলবো কোনোদিন।

জ্বর থেকে উঠে নিবেদিতা সরাসরি প্রাঞ্জল কে বলে তুমি যেমনই হও, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। ফোনের অইপাশে অট্টহাসি তে নিবেদিতার কান ফেটে যাবার পালা। প্রাঞ্জল খুব আবেদন পূর্ণ গলায় বলে ;নিবেদিতা, আমি তোমার বর খুঁজে দেবো। তোমার ঘর, সংসার সব হোক। শুধু আমার সাথে যে আত্মিক বন্ধুত্ব সেটা নষ্ট করো না। নিবেদিতা এবার, গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে আমি তোমাকে ভালোবাসি প্রাঞ্জল। তুমি যেমনই হও, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। প্রাঞ্জল বলে, দেখলে আর চাইবে না। নিবেদিতা বলে বেশ দেখা করেই সিদ্ধান্ত নেবো। তবে বন্ধুত্ব কোনদিন যাবে না। প্রাঞ্জলও এই একই শর্তে দেখা করতে রাজি হয়।

ঠিক হয় কোন উম্মুক্ত প্রান্তরে খোলা আকাশের নীচে তাঁদের দেখা হবে। তারপর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাঁরা অন্য কোথাও যাবে। প্রাঞ্জল নিবেদিতা কে বলে সে মেরুন গেঞ্জি আর কালো জিন্স পরে আসবে। যদি নিবেদিতার সিদ্ধান্ত ইতিবাচক হয়, তাহলে নিবেদিতা সামনে আসবে নতুবা আজ দেখা হবে না। অন্য কোনোদিন তারা কোনো কফিশপে দেখা করবে।

নিবেদিতার মনে এক সমুদ্র সুনামি। তারপরও খুব সুন্দর করে সাজলো সে। প্রাঞ্জলের লাল রঙ প্রিয়। নিবেদিতা লাল শাড়ি পরলো, লাল লিপষ্টিক, লালটিপ খোঁপায় গাজরা পরলো। খোঁপা প্রাঞ্জলের খুব পছন্দ। আসতে আসতে ভাবছে নিবেদিতা ; প্রাঞ্জল কি খুব কালো? কিম্বা অসম্ভব মোটা! কোথায় প্রাঞ্জলের সমস্ত সংশয়? তারা আজ ধানমন্ডি লেকে দেখা করতে এসেছে। নিবেদিতা একটা ল্যাম্পপোস্টের আড়াল থেকে দেখার চেষ্টা করে । খুঁজে পায় না। ফোন দেয় প্রাঞ্জলকে! জিজ্ঞেস করে পৌঁছে গেছি তুমি বঙ্গবন্ধুর বাড়ির এদিকটাতে আস। এবার নিবেদিতার নিজের সাথে যুদ্ধ! কাকে দেখছে সে! প্রাঞ্জল অত্যন্ত নাতিদীর্ঘ একজন মানুষ। তার উচ্চতা চার ফিট দুই ইঞ্চি হবে। মুহূর্তে ই নিজের সাথে বোঝাপড়া করতে হবে। পাঁচ মিনিট সময় নিয়ে ভাবে কার উচ্চতা বেশি তাঁর প্রেমের, আত্মিক বন্ধুত্বের নাকি এর দেড় ফিট শারিরীক উচ্চতার? প্রাঞ্জলের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে দিচ্ছে সবই। প্রাঞ্জল শুধু মনে মনে বলছে “তুমি সংশয় মুক্ত হয়ে আস”

পাঁচ মিনিটের স্থলে দশ মিনিট সময় নেয় নিবেদিতা। নাহ সে প্রাঞ্জল কে ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতে পারছে না। পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে প্রাঞ্জল কে। প্রাঞ্জল গভীর রাতের চেয়েও বেশি চুপ! শুধু জিজ্ঞেস করছে, তোমার কোনো সংশয় নেই নিবেদিতা? নিবেদিতা বলছে, আছে জিরো ভাগ। এবার দুজন হাসতে হাসতেই কেঁদে ফেলছে। প্রাঞ্জল ওর আর নিবেদিতার চোখের দুইবিন্দু অশ্রু এক করে ফেলে। তারপর বলে এই নোনাজলের কসম জীবন থাকতে আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো না। এরপর ঠোঁটে স্পর্শ করে দেয় নিবেদিতার চোখ।

দুজনে সারাদিন ঘোরাফেরা করে, খাওয়া দাওয়া করে, দুজন দুজনকে শাড়ি, শার্ট গিফট করে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরে। হাসিমুখে ফিরতে দেখে নিবেদিতার বাবা, মা খুব খুশি হয়। প্রাঞ্জল নিবেদতার কাছে বাসার সবার জন্য সন্ধ্যার নাস্তা পাঠিয়ে দেয়। নাস্তা খেয়ে সবার আগে নিবেদিতার মা বলে তোদের ছবি দেখা। ছবি দেখতে দেখতে নিবেদিতার মা বলেন, তোর পাশে এটা কে? ছেলের ছোট ভাই? ছেলে কই? নিবেদিতা বলে, মা এটাই প্রাঞ্জল। ওর শারিরীক উচ্চতা একটু কম।
সাথে সাথে নিবেদিতার মা বলেন, এত বামন! নিবেদিতা বলে মা এভাবে বল না। ও খুব ভদ্র, যোগ্য অমায়িক একটা ছেলে। এক দেড় ফিট শারিরীক উচ্চতার জন্য কারও সব গুন নষ্ট হয়ে যায় না। নিবেদিতার মায়ের এক কথা, যত গুন থাক বামনের কাছে মেয়ে দিলে ; আত্মীয় স্বজনের কাছে মুখ দেখাতে পারবো না!

নিবেদিতা ভাবে একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে। মা বুঝতে পারবেন। বাবা নিমরাজি হয়ে আছেন। প্রাঞ্জল জানতে চেয়েছে বাসার সবার মতামত। নিবেদিতা বলেছে, মা একটু আপত্তি করছেন। আমি ম্যানেজ করে ফেলবো। বাবা, ছোট বোন সবাই রাজি। প্রাঞ্জলও কোথায় যেন আশ্বস্ত হয়।

নিবেদিতার মা অন্য ছক আঁকেন মনে মনে। তিনি ঘটক ডেকে পাঠান। ঘটক আসলে বলেন, যা যৌতুক বা টাকা পয়সা লাগে তিনি দেবেন। কিন্তু একটা উঁচা লম্বা, মোটামুটি শিক্ষিত ছেলে চান তিনি। আর নিবেদিতার বাবাকে বলেন; গ্রামের বাড়ির জমিগুলো বিক্রি করে টাকার ব্যবস্থা করতে। নিবেদিতার বাবা বলেন, মেয়ের যেহেতু পছন্দ ছেলেটাও তো যোগ্য। নিবেদিতার মায়ের এক কথা; সারাজীবন বিয়ে না হলেও তিনি মেয়েকে বামনের কাছে বিয়ে দেবেন না।

ঘটক এসেছিলো নিবেদিতার অনুপস্থিতিতে, নিবেদিতা তখন কলেজে ছিল। শুক্রবার ঘটক আবার এসেছে। নিবেদিতার মা নিবেদিতা কে ডেকে পাঠান। নিবেদিতা আসলে, একটা ৫ ফিট ৭ ইঞ্চি ফর্সা ছেলের ছবি হাতে দেন। বলেন দেখ, সোনার টুকরো ছেলে। ডিগ্রি পাস,ব্যাবসা করে। শুধু ছয় মাসের ডিভোর্সী। বউ চলে গেছে ওর দোষ কি? আর ব্যাবসার সাহায্যের জন্য লাখ পাঁচেক টাকা চেয়েছে। নিবেদিতা কিছু না বলে, ছবিটা রেখে চলে আসে।

এবার নিবেদিতা প্রাঞ্জল কে না জানিয়ে পারে না। প্রাঞ্জল ধৈর্য ধরে শান্তভাবে পরিস্থিতি সামলাতে বলে। প্রাঞ্জল বলে চুপচাপ নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে। যেদিন সবকিছু তাদের অনুকূলে আসবে সেদিন তারা বিয়ে করবে। নিবেদিতাও প্রাঞ্জলের কথা মেনে নেয়। কিন্তু ছোট বোন, মা কেউ ওর সাথে তেমন কথা বলছে না। বাবা বলছেন। ভীষণ অসহায় হয়ে পড়েছেন তিনি। কোনদিকে যাবেন তিনি? মেয়ের কষ্ট ও সহ্য হয় না আবার স্ত্রীর মেজাজ আর কথাকেও তিনি উপেক্ষা করতে পারেন না।

তারপর ও নিবেদিতা চুপচাপ আছে ভাবছে ছোট বোন মা সবাই একসময় বুঝতে পারবে। আজ মঙ্গলবার হঠাৎ ছোট বোন নতুন শাড়ি কিনে নিয়ে আসে। বলে চল তোকে নিয়ে মা পার্লারে যেতে বলেছে। নিবেদতা খুব সুন্দর করে রসিকতা করে বলে, ক্যান পার্লারে গিয়ে কী আমাকে সাদা করে ফেলবি? আমি যেমন আছি তেমনই ভালো। এরমধ্যে মা এসে বলে, শুক্রবার ছেলে পক্ষ আসবে। গিয়ে হাত পা মুখ ফেয়ার পলিশ করে আসো। নিবেদিতা খুব শক্ত হয়ে বলে। আমি কোনো ছেলে পক্ষর সামনে যাবো না। প্রাঞ্জল অনেক যোগ্য ছেলে বিয়ে করলে ওকেই করবো নতুবা করবো না। নিবেদিতার মা বলে, আমি তোমাকে বামনের কাছে বিয়ে দেবো না। প্রয়োজনে তোমাকে ত্যাগ করবো। নিবেদিতা কাঁদতে কাঁদতে বলে তাই কর, তাও ভালো। কিন্তু আমি অন্য কাউকে বিয়ে করবো না। নিবেদিতার মা গালে থাপ্পড় কষে দিয়ে বলে তুই বাসা থেকে বেরিয়ে যা।

নিবেদতা কিছুক্ষণ কাঁদে আর আর ভাবে এক ফুট শারীরিক উচ্চতার কাছে সব অর্জন মিথ্যে হয়ে যায়! প্রাঞ্জল কে ফোন করে নিবেদিতা সব জানায় আর বলে কাল ও বাসা থেকে বেরিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে বান্ধবীর বাসায় উঠবে। প্রাঞ্জল বলে বিকেলে আমার অফিসের কাছে একটা কফি শপে বসবো। নিবেদিতা বলে আচ্ছা তাই হবে।

পরদিন সকালে নিবেদিতা ওর একটা ব্যাগে কাপড় আর ওর কসমেটিকস গুলো নিয়ে যখন বেরুতে যায় তখন সবাই নাস্তার টেবিলে। নীহার, নীরুর ছেলে বলে ওঠে আম্মু কোথায় যাও? নিবেদিতা ওকে আদর করে বলে বন্ধুর বাসায় যাই মিষ্টি আব্বুটা। আম্মু বাসা নিয়ে তোমাকে নিয়ে যাবো। চিৎকার করে ওঠে নিবেদিতার মা। বলে বেরিয়ে গেলে জীবনে আমার মুখ দেখবি না। আমি মারা গেলেও না। কোনো কথা না বলে বেরিয়ে যেতে নেয় নিবেদিতা। হঠাৎ নিবেদিতার মা’র গলা, ওগো ওকে আটকাও। চোখ বড় করে মূর্চ্ছা যান তিনি। নীরু চিৎকার করে ওঠে আপু মা কথা বলছে না। নিবেদিতা ব্যাগ ফেলে দৌড়ে এসে মা মা বলে ডাকতে থাকে।

দ্রুত নেয়া হয় হাসপাতালে। ডাক্তার নিরীক্ষা করে বলেন হার্ট এটাক। দুইদিন পর সেন্স ফিরে আসে। ডাক্তার বলেন একটু স্থির হলে সুস্থ হয়ে ওপেন হার্ট সার্জারি করতে হবে। কিন্তু এর ভেতর ওনাকে উত্তেজিত করা যাবে না। আর নিবিড় যত্ন নিতে হবে।মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। নিবেদিতা মায়ের সামনে যায় না। বাবা, বোন দুজনেই নিষেধ করেছে ওকে সামনে যেতে। তৃতীয় দিন রাহেলা বেগম নিজেই ডেকে পাঠান নিবেদিতা কে। বলেন একটা কাগজ কলম দে। দেয়া হয় কাগজ কলম।

লিখে দেন রাহেলা বেগম, ” আমি জানি প্রাঞ্জল মেধা,মানুষিকতা, চাকরি সবদিক থেকে যোগ্য একটা ছেলে। কিন্তু সমাজ কখনও বামন কে মেনে নেবে না। পদে পদে তুই অপদস্ত হবি। আমি মা হয়ে সেটা হতে দিতে পারি না। আমি মরে গেলেও তুই ওকে বিয়ে করবি না। যদি ইচ্ছা হয় বন্ধু হয়ে থাকিস। আমার বুকের দুধের কসম রইলো তুই ওকে বিয়ে করবি না। আমি দোয়া করি তোর সুন্দর একটা লম্বা ছেলের সাথে বিয়ে হোক। সুন্দর ফুটফুটে বাচ্চা হোক। ওকে বিয়ে করলে তোর যদি বামন বাচ্চা হয়! ভালো থাকিস মা।

নিবেদিতার চোখ আজ পাথর। তাতে না আছে কষ্ট, না হতাশা, না দুঃখ। শুধু এক পৃথিবী অন্ধকার। মায়ের অসুস্থতার কথা প্রাঞ্জল কে গতকাল ই জানিয়েছে। এক ফাঁকে বেরিয়ে প্রাঞ্জলের সাথে রিক্সায় ঘুরে এসেছে। দুজনে সিদ্ধান্ত নেয় আপাতত বন্ধুত্বই থাক। নিবেদিতা ওর নিজের বাসাতেই থাকবে।

এভাবে চলে যায় ছয় মাস। একদিন প্রাঞ্জল খুব উচ্ছ্বসিত। রিক্স্যয় উঠেই নিবেদিতার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিয়েছে। হাসতে হাসতে বলে তুমি আজ যা খেতে চাও তাই পাবে। তারা দুজনে মিলে পছন্দের শিককাবাব আর নান খায়। আইস্ক্রীম কিনে খেতে খেতে যেয়ে বসে ক্রিসেন্ট লেকে।

হঠাৎ কথা বলার এক ফাঁকে প্রাঞ্জল নিবেদিতাকে শুধায়, নিব আমি তোমাকে সবকিছু তে আমার পাশে পাবো? নিবেদতা হো হো করে হেসে ওঠে। বলে আজও এই প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক? তাও বলছি পাবে। আমি আমার সবটুকু সাধ্য দিয়ে থাকবো। এবার প্রাঞ্জল নিবেদিতার কাঁধে মাথা রাখে বলে, আমি বামনদের জন্য কিছু একটা করতে চাই। যাতে ওরা সঠিক শিক্ষা পায়, চিকিৎসা পায় এবং নিজের মেধা বিকশিত করে নিজের যোগ্য কর্মক্ষেত্র বেছে নিতে পারে। এবার নিবেদিতা খুব খুশি হয়। বলে আমি আমার সমস্ত প্রেম দিয়ে তোমার পাশে থাকবো। নাম দেবে কী? নিবেদিতা বলে, উচ্চতা(বামন ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্ট)।

আপাতত সিদ্ধান্ত হয় প্রাঞ্জলের বাসায়ই আপাতত “উচ্চতা ” এর কাজ হবে। সপ্তাহান্তে নিবেদিতা আর প্রাঞ্জল একসাথে কাজে বসবে।

নিবেদিতা আর প্রাঞ্জলের ধ্যান জ্ঞান হয়ে দাঁড়ায় উচ্চতা। টাকা জোগাড় করা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কে ডোনেশন করার জন্য অনুরোধ করা, একজন উকিলকে দিয়ে প্রতিষ্ঠান এর আদর্শ, কর্মপন্থা তৈরি করা সব দুজনেই করছে। দুজনে প্রচুর টাকাও খরচ করছে।

বামনদের শিক্ষায় অনুদান দেয়া, কাউন্সিলিং করা, তাঁদের বোঝানো যে বামন হওয়া তাদের অপরাধ নয়। তারাও মেধা ও কাজ দিয়ে দেশ ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে। তাছাড়া বামনদের জন্য চাকরি ক্ষেত্রে কোটার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রায়ই ছুটির দিনে কাজ করতে করতে বাইরে খেতে বেরিয়ে যায়। আবার কখনো নিবেদিতা বাসা থেকে প্রাঞ্জলের প্রিয় খাসির মাংস আর খিচুড়ি রান্না করে নিয়ে আসে। পুরোটাই মেনে নিয়েছে প্রাঞ্জলের বাবা মা আর নিবেদিতার বাবা। শুধু কেউই আর বিয়ের কথা মুখে আনছে না।

প্রাঞ্জল আর নিবেদতা ও সুখী। ভালো কিছু করছে একসাথে এতেই ওদের আনন্দ। দুই বছর টানা কাজ করার পরে পরিচিত, বন্ধু বান্ধব সবাই প্রাঞ্জলের কাজের প্রশংসা করছে। উচ্চতার এখন নিজস্ব অফিস আছে।বেশ কয়েকজন স্টাফ আছে। বেশ জোরেশোরে ই এগিয়ে যাচ্ছে “উচ্চতা”। নিবেদিতা কলেজের বাইরে পুরো সময়টা উচ্চতাকে দেয়। উচ্চতা পরিপুষ্ট হয়ে ওঠে নিবেদিতা আর প্রাঞ্জলের রক্তকে ঘাম করে।

তিন বছরের মাথায় বাংলাদেশ মানবাধিকার সংগঠন থেকে চিঠি আসে। প্রাঞ্জল আর নিবেদিতা কে তারা আমন্ত্রণ করে। উচ্চতার জন্য তুলে দেয় দুই লক্ষ টাকা অনুদান। আর একটা চিঠি দেয় যেটা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন থেকে এসেছে। বাংলাদেশ মানবাধিকার সংগঠন লিখেছিল এই প্রতিষ্ঠানের ব্যপারে। লিখেছিল নিবেদিতা আর প্রাঞ্জলের ত্যাগ আর নিষ্ঠার ব্যপারে। চিঠিটা হাতে নিয়ে নিবেদিতা আর প্রাঞ্জল দুজনেই নিশ্চুপ হয়ে যায়। তারপর দুজনেই দুজনকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে করে কেঁদে ওঠে। ওদের নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের সদর দফতর থেকে। সেখানে ওরা ওদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করবে, ওদের ক্রেস্ট দেয়া হবে আর প্রতিষ্ঠান পাবে পঞ্চাশ লক্ষ টাকার অনুদান।

দুজনে বেরিয়ে প্রথমে একটা ভালো চাইনিজ রেষ্টুরেন্টে যায়। নিবেদিতার পছন্দের ক্যাশন নাট সালাদ, অন্থুন, চিকেন কর্ন স্যুপ সব অর্ডার করে। অনেকদিন পর দুজনে অনেকক্ষণ ধরে ডিনার করে। খেতে খেতেই নিবেদিতা জানতে চায় স্পীচ কবে রেডি করবে? প্রাঞ্জল বলে আজ রাতেই খসড়া করে তোমাকে মেইল করবো। নিবেদিতা বলে, উচ্চতা হোক মেধার, উচ্চতা হোক মননের সর্বোপরি উচ্চাতা হোক প্রেমের আর মানবতার। এই কথাগুলো যেন থাকে।

প্রাঞ্জল নিবেদিতাকে পৌঁছে দিতে চায় কিন্তু নিবেদিতা না করে। বলে বাবার জন্য ঔষধ কিনে নিয়ে আমি চলে যেতে পারবো।

আজ প্রাঞ্জল কে একদম ছাড়তে ইচ্ছা করেনি নিবেদিতার। আজ ওর বুকের মধ্যে সারা রাত ঘুমাতে ইচ্ছা করেছে। নিবেদিতা ঔষধ কিনে আনমনে হাঁটছে আর ভাবছে, মা বসুধা তুমি কেমন! তুমি এক হাতে ছিনিয়ে নাও, অন্য হাতে ফিরিয়ে দাও। যা নাও তা দাও না দাও অন্যকিছু। তুমি সব বোঝ, প্রেম বোঝ না! ভাবতে ভাবতে চোখ মুছতে মুছতে রাস্তা পাড়ি দেয়ার জন্য হাঁটছে। হঠাৎ একটা মটর সাইকেলে ধাক্কা লেগে পড়ে যায় নিবেদিতা। আর মুহূর্তে ই একটা বাস চলে যায় তার বামপাশের ওপর দিয়ে। রাত এগারোটা রাস্তায় দুই তিনজন লোক যারা ছিল তারা হাসপাতালে নিয়ে যায়। অই লোকজনরাই নিবেদিতার বাবাকে ফোন করে। দৌড়ে যায় বাবা। খবর দেয়া হয় নিবেদিতার বোনকেও। ততক্ষণে নিবেদিতা আইসিইউ তে। ডাক্তার জানিয়েছেন মস্তিষ্কে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে।

বাসায় ফিরে প্রাঞ্জল গান শুনছিল, “কেন আর সরে আছ দূরে কাছে এসে হাত দুটি ধর, শপথের মনকাড়া সুরে আমায় তোমারই তুমি কর” রাত বারোটা অব্দি নিবেদিতার ফোন না পেয়ে এবার ফোন দেয় নিবেদিতা কে। ফোন ধরে নিবেদিতার বাবা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। বলে বাবা তাড়াতাড়ি আসো হাসপাতালে। নিবেদিতা এক্সিডেন্ট করেছে, আইসিইউ তে। ততক্ষণে রাত সাড়েবারোটা। প্রাঞ্জল নিজেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়। ড্রাইভিং মোটামুটি ভালোই জানে। ড্রাইভ করছে আর ভাবছে নিবেদিতা সুস্থ হলে এবার কাজি অফিসে গিয়ে বিয়েটা সেরে ফেলবে। তারপর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থায় যাবে আর হানিমুনটাও সেরে আসবে। কিচ্ছু হবে না নিবেদিতা সুস্থ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। শুধু নিবেদিতা কে নতুন বউয়ের রূপে কল্পনা করছে আর হেসে উঠছে আনমনে। নিয়তির নিষ্ঠুর হাসির কদর্য শব্দ তখনও প্রাঞ্জলের কানে আসেনি। এরই মধ্যে একটা বিশাল ট্রাক দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে যায় প্রাঞ্জলের গাড়িটাকে!

তখন একটা ভীরু হরিন শাবক কোনো এক সবুজ অরন্যে মনের সুখে বিচরণ করছিলো। শুধু নিয়তির ক্রুর হাসিতে সে পালানোর কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না আর!

লেখকঃ নুসরাত সুলতানা
কবি ও কথাসাহিত্যিক