সময়টা উনিশশো ছত্রিশ। একটা দশ বছরের মেয়ে শান্তিনিকেতনে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হলো। সেই বছরই প্রথম মঞ্চস্থ হবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত “চিত্রাঙ্গদা”। স্বয়ং গুরুদেব এই নৃত্যনাট্য পরিচালনা করছেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় রিহার্সাল হতো আর ক্লাস ফাইভ সিক্সের ছাত্রছাত্রীদের সেই রিহার্সাল দেখা বাধ্যতামূলক ছিল। তো সেই বাচ্চা মেয়েটিও রবীন্দ্রনাথের পাশে বসে রিহার্সাল দেখতো। আর রিহার্সাল শেষ হতে রাত হয়ে যেত বলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গেই সেই ছোট ছোট ছাত্রছাত্রীদের একসঙ্গে এক টেবিলে বসিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হতো। পরিবেশন করতেন বিশ্বকবির পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। রবীন্দ্রনাথ স্বল্পাহারি ছিলেন। অনেক রকম পদ রান্না হলেও তিনি তার থেকে খুব কমই খাওয়ার জন্য তুলে নিতেন। এ দেখে অবাক হয়ে সেই বালিকার প্রশ্ন গুরুদেবকে– “তুমি এতো ভালো ভালো খাবার খাচ্ছো না কেন”? গুরুদেব স্মিত মুখে উত্তর দিতেন “তোরা পেট ভরে খা”। সেই বালিকার আবার প্রশ্ন “এইটুকু খেলে রাত্রে তোমার খিদে পেয়ে যাবে না?” রবীন্দ্রনাথ এবং প্রতিমা দেবী দুজনের মুখেই তখন হাসি। ভারি মজা পেয়েছেন তাঁরা এমন সরল প্রশ্ন শুনে…. এই বালিকাটির নাম মহাশ্বেতা ঘটক… পরবর্তী কালে যাকে সারা দেশের মানুষ “হাজার চুরাশির মা”র শ্রষ্টা হিসেবে চিনেছিল… হ্যাঁ, আমি আজ সেই মহাশ্বেতা দেবীকে নিয়েই কথা বলবো।
তাঁর জন্ম ঢাকায়- ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ই জানুয়ারি। মা ধরিত্রী ঘটক ছিলেন কবি এবং সমাজসেবী, বাবা কল্লোল যুগের বিখ্যাত কবি মণীষ ঘটক যার ছদ্মনাম ছিল “যুবনাশ্ব”। কাকা চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক যার পরিচয় দেওয়াটা বাহুল্য মাত্র। এমন একটি পরিবারে জন্ম নেওয়া মহাশ্বেতা যে ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য আর সুসংস্কৃতির আবহে বড়ো হবেন এবং সাহিত্যকেই জীবন জীবিকা হিসেবে বেছে নেবেন সে আর নতুন কী? দশ বছর বয়সে তাকে শান্তিনিকেতনে ক্লাস ফাইভে ভর্তি করে দেওয়া হয়। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত সেখানে পড়ে তিনি আবার তার মা বাবার কাছে চলে আসেন এবং কলকাতার বেলতলা গার্লস স্কুল থেকে স্কুলের পড়া শেষ করে আবার পড়তে চলে যান শান্তিনিকেতনে। সেখান থেকেই ইংরেজি অনার্স নিয়ে বি এ পাশ করেন এবং তারপর কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে এম এ পাশ করেন।
তিনি যে কত বড় মাপের সাহিত্যিক ছিলেন একথা আর নতুন করে বলার কিছুই নেই। “অরণ্যের অধিকার” উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৭৯ সালে সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পান। সাহিত্যের প্রায় সমস্ত পুরস্কারই তিনি পেয়েছিলেন। পান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লীলা পুরস্কার, ভারতের সবচেয়ে বড় সাহিত্য পুরস্কার “জ্ঞানপীঠ” পুরস্কার এবং “রামন ম্যাগসেসে” অ্যাওয়ার্ড। তিনি পেয়েছেন ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান “পদ্মবিভূষণ” খেতাব এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রদত্ত “বঙ্গবিভূষণ” খেতাব। ২০০৭ সালে সাহিত্য কীর্তির জন্য পান সার্ক পুরস্কার। তাঁর বিখ্যাত রচনাগুলির অন্যতম হলো ঝাঁসির রানী, হাজার চুরাশির মা, চোট্টি মুণ্ডার তীর, স্তনদায়িনী, অরণ্যের অধিকার, নৈঋতে মেঘ, অগ্নিগর্ভ, গণেশ মহিমা, শালগিরার ডাকে, নীল ছবি, বন্দোবস্তী, আই পি সি ৩৭৫, সাম্প্রতিক, প্রতি চুয়ান্ন মিনিটে, মুখ, কৃষ্ণা দ্বাদশী, ৬ ডিসেম্বরের পর, বেনে বৌ, মিলুর জন্য, ঘোরানো সিঁড়ি, লায়লী আশমানের আয়না, আঁধার মানিক, যাবজ্জীবন, শিকার পর্ব, অগ্নিগর্ভ, বাসাই টুডু, তিতু মীর, রুদালী, ঊনত্রিশ নম্বর ধারার আসামী, প্রস্থানপর্ব, ব্যাধখণ্ড এবং আরো আরো অনেক….. । তাঁর লেখা “হাজার চুরাশির মা” নিয়ে সিনেমা তৈরি করেছিলেন বিখ্যাত পরিচালক গোবিন্দ নিহালনি। এছাড়াও তাঁর রচনা থেকেই তৈরি হয় আরো বেশ কটি সিনেমা যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো “রুদালি” এবং “গঙ্গৌর”।
বারবার তিনি আদিবাসী মানুষদের উপর হওয়া অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন। তাঁর লেখায় বহুবার উঠে এসেছে সমাজের প্রান্তিক মানুষদের সুখ দুঃখের কথা, তাদের শোষণ ও বঞ্চনার কথা। আজ, পুরোপুরি না হলেও আদিবাসী মানুষরা যে সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত হয়েছেন, প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন, সামাজিক ন্যায়বিচার ও পাচ্ছেন, তার পিছনে মহাশ্বেতা দেবীর অবদানের কোনো সীমা পরিসীমা নেই।
২০১৬ সালের ২৮শে জুলাই মৃত্যু হয় মহাশ্বেতা দেবীর।