তাঁর জন্ম ১৯৪০ সালের বাইশে জুন, ইরানে। কিয়ারোস্তমি ইরানের বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক। সারা পৃথিবীতে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং সুখ্যাত। অসংখ্য অসাধারণ ছবি তৈরি করেছেন তিনি, পুরস্কৃত হয়েছেন নানা বিশিষ্ট পুরস্কারে।কিয়ারোস্তমি আমার অসম্ভব প্রিয় ফিল্ম ডিরেক্টর। যে কয়েকজন চিত্র পরিচালক আমাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছেন এবং করে আছেন, তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর ছবির ভাষা একেবারে অন্যরকম। কবিতার কাছাকাছি। তাঁর ছবি সম্পর্কে বলতে গেলে দীর্ঘ আলোচনা করতে হবে। তাঁর একটা ছবি আমাকে বিশেষভাবে নাড়া দিয়ে যায়। ছবিটি হল – ‘Taste of Cherry’. ছবিটা যতবার দেখেছি, কাকতালীয়ভাবে তা রাতে শোওয়ার আগে। একথা আগেও একবার ফেসবুকে লিখেছিলাম। এই ছবিতে একজন মধ্যবয়সী লোক আত্মহত্যা করবেন বলে মনস্থির করেন এবং মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহ সৎকার করার জন্য একজন মানুষ খুঁজে বেড়ান গোটা ছবি জুড়ে। এর মধ্যে নানা ছোটো-বড়ো ঘটনা ঘটে এবং ছবি এগোতে থাকে। ছবির শেষটা অত্যন্ত আকর্ষক। সেটা আর এখানে লিখছি না। সব লিখে দিলে দেখার আনন্দ কিছুটা হলেও কমে যায়। এই ছবি রাতে দেখে শোওয়ার পর প্রত্যেকবার কাকতালীয়ভাবে একটা বিশেষ স্বপ্ন ফিরে ফিরে আসে আমার কাছে। এক দিগন্তবিস্তৃত চা বাগান আর তার ভেতরে একটা ছোট্ট পায়ে হাঁটা পথ। সেই পথে হেঁটে যেতে যেতে কোথায় যেন ক্রমশ হারিয়ে চলেছি। বার বার এই স্বপ্ন কেন আসে – সে কথা সত্যি জানি না। মন নিয়ে যাঁরা কাটাছেঁড়া করেন, তাঁরা হয়তো ব্যাখ্যা করতে পারবেন। হয়তো বা না। আর এই স্বপ্নের শেষে ঘুম ভাঙার পর দীর্ঘক্ষণ তার রেশ থেকে যায়। মনে হয় – একা, কেবলই একা হেঁটে যাচ্ছি সবুজ চা বাগানের ভেতর দিয়ে। নেশার মতো ঘোর লাগে। সত্যি বলতে কি, এই ঘোর ছেড়ে বেরোতে নিজেও চাই না হয়তো। ঘোরটা কেটে গেলেই তো সেই আদ্যন্ত শহুরে একটা জীবন, রোজকার নামা-ওঠা, এগোনো-পিছোনো, বয়ে চলা পথ। ‘Taste of Cherry’ ছবিটা বড়ো মায়া জড়ানো। ছবির প্রতিটা ফ্রেম যেন একেকটা কবিতা। কিয়ারোস্তমি ছবি পরিচালনার পাশাপাশি ছবির চিত্রনাট্য লিখতেন, প্রযোজনা করতেন। ভীষণ ভালো ফোটোগ্রাফার ছিলেন তিনি। তাঁর তোলা ছবির ভেতরে একটা অদ্ভুত মাদকতা আছে, আছে এক গভীর টান। তাঁর সিনেমাতেও ছড়িয়ে থাকে এই নেশা। দৃশ্য আর শব্দ সেখানে একে অপরের পরিপূরক। কিয়ারোস্তমি কবি। খুব ভালো কবি। তিনি তাঁর সিনেমাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন কবিতার ভাষা। ছবি আর কবিতা কোথাও যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আজ তাঁর জন্মদিনে তাঁর ছোটো-ছোটো কয়েকটা কবিতা অনুবাদ করলাম। কবিতাগুলো দিলাম এখানে…
১. সপ্তাহের পর সপ্তাহ,
মাসের পর মাস
আমার প্রতিটা দিন
অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। আমরা এখন দাঁড়িয়ে
আছি হেমন্তের শেষে আর আমি ফিরে দেখছি বসন্তকে।
২. যে মুহূর্তে আমি পেরিয়ে গেলাম
পাগলামির সীমারেখা,
আমার সামনের পথ ক্রমশ মসৃণ হয়ে গেল।
৩. প্রতি রাতে মারা যাই আমি।
আর ধীরে ধীরে ভোর হলে পুনর্জন্ম হয় আমার।
৪. তোমার অনুপস্থিতিতে আমি কথা বলি তোমার সঙ্গে,
যখন তুমি কাছে থাকো – নিজের সঙ্গে কথা বলি আমি।
৫. যখন আমার পকেটে কিছু থাকে না,
কবিতা থাকে আমার কাছে।
যখন আমার রেফ্রিজারেটরে থাকে না
কিছু,
আমার কাছে কবিতা থাকে।
যখন আমার হৃদয়ে কিছু থাকে না,
তখন আমি নিঃস্ব… & প্রমিতা ভৌমিক