শার্সিকাচ
তুমি এক চতুর শেয়ালি;
অ-ব্যাখ্যেয়, অপ্রমেয় তুমি
বৈঠার মতোন এক ভারী লেজ বাতাসে ভাসিয়ে
নিজের গুহার থেকে বের হয়ে
ঢুকলে গিয়ে অন্যদের গুহার ভেতরে
ঘুরন্ত সিঁড়ির নিচে গাঢ় অন্ধকার; তুমি সেখানেই
ওঁত পেতে রইলে সারারাত
জানালার শার্সিকাচে ঝুলে রইলো
নিরুপায় তোমার ক্রন্দন
দীর্ঘ শীতে, দীর্ঘ-দীর্ঘ অরব রাত্রির শত ঘুমন্ত টানেলে
তোমাকে ঝুলিয়ে রাখল শ্বেত ও ধূসর ঊর্ণাজাল। তুমি
অবিরাম হামা দিলে
কুঁকড়ে গেলে শীতে;
আপন যোনির তাপে
ভস্ম হলে, মরে গেলে শীতে!
খোজাদের খাপে ভরা অতৃপ্ত শিশ্নের আর্তনাদ
আছড়ে পড়ল সম্রাজ্ঞীর বিপুল জঘনে
জোৎস্নায় ভূতগ্রস্ত প্রাসাদকঙ্কাল
আজ সব ব্যর্থতাকে ঢেকে রাখে
রাশি রাশি অভিশপ্ত খিলানে, গম্বুজে
তস্কর
————
তোমার সূর্যের থেকে ঝরে পড়ে তামা
তুমি এক জন্মবোবা বধির ডাকাত
একদিন আষাঢ়সন্ধ্যায়
পাহাড়ের ঢালে তুমি খুঁজে পেলে
ঘুমের ফরমালিনে ডুবে থাকা
একা এক নির্মানুষ বাড়ি
এর পেটের ভেতরে পেলে রত্নপাথর, পেলে নাকছাবি
পেলে পায়ের ঘুঙুর আর স্তনের কাঁচুলি
—এসবের ঘুমন্ত ঝিলিক যেন লীলা
সে-বাড়ির করোগেট চালে অতি ধীরে
মেঘ এসে হামা দেয় বেড়ালের মতো;
তাদের তাড়িয়ে নিতে হাওয়া আসে চাবুকসমেত
হে তস্কর
তুমি সেই দৃশ্যকে ঝোলায় পুরে
প্রদোষের অন্ধকার পথে নেমে যাবে?
রাতের আকাশ ঠিক তোমাকে শিকার করে নেবে;
তোমাকে ঘণ্টার মতো রাখবে ঝুলিয়ে এক অদৃশ্য আংটায়
ধরো, টগবগে ঘোড়ায় আসীন এক অজানা দেশের সেনাপতি
একদিন ঘণ্টাটাকে আংটামুক্ত করে
আকাশগঙ্গায় চুপে দিয়েছে ভাসিয়ে;
ছাড়া পেয়ে সেই ঘণ্টা
বাতাসে টুপির মতো
উড়ে গেল ছদ্মবেশে, মেঘের মুখোশে
কাক ও কাকিনী
১.
করোগেট চালে দাঁড় কাক
কাকিনীরে দিতে উপহার
শিকারিল নধর মূষিক
ইতিউতি খুঁজে দ্যাখে—— নাইইইইইইই
কুচকুচে ডানার হ্লাদিনী
কা-কা কা-কা!
চরাচর ফাঁকা!
২.
অন্য ধামে তখন কাকিনী
মহাসুখে নব নাগরের
চঞ্চুতে চঞ্চু চলে ঘষে
দুপুরের এই অপরূপ
দৃশ্যের নিবিড় তামাশা
দুপুর নিজেই বসে আঁকে
হ্যামলেট পাঠ
রাত জেগে হ্যামলেট পড়ে
জানালার বাইরে তাকাবো, আর,
না-শোনার মতো বিড়বিড়
আওড়াবো ধীরে:
ডাউট দাউ
দ্য স্টারজ
আর ফায়ার…!
কৌটোর ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে
এখন কৌটোর ভেতরে লুকিয়ে রাখছি নিজেকে। হীরের নাকছাবি যেন।একটু পরপর কৌটোর মুখ খুলে দেখছি ঠিকঠাক আছি কিনা। তোমার মরালগ্রীবা থেকে এখন সরে যাচ্ছে আমার চোখ; ভয়ে ও অপ্রেমে। এখন পত্রমোচী গাছের পাতার মতো ঝরে পড়ছে সম্পর্কের চুম্বকাবেশ। মনে হচ্ছে, এক ছদ্মবেশী আমাজনি তুমি।
দূরে থাকো ! ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না!
কোথাও যুদ্ধ হচ্ছে।নির্দামামা-নিরায়ুধ। তবু কোনও রক্ত ঝরছে না। কেউ সাইরেন বাজাচ্ছে না, কেউ তাক করছে না কালাশনিকভ। তবু প্রত্যেক ঘরের কোণে কুরুক্ষেত্র। কশেরুকা আর মগজে আততায়ী ঘুরছে; তাকে দেখা যাচ্ছে না ; অথচ জারকাঁটা দিচ্ছে সারা গায়ে। সে নেই তবু আছে।
‘নাই-আর-আছি’র মাঝখানে তার রুদ্রপ্রতাপ। যা মহামহিম সেকান্দর আর নেবুশাদনেজারের সম্মিলিত প্রতাপের অধিক। কেউ দেখতে পাচ্ছে না তার চেহারা, তার চাকু, তার রণরক্তেভেজা কৌপীন।
আমাদের হাসি আর গোলাপের ভেতর আলগোছে সে মিশিয়ে দিচ্ছে কালকূট; আমাদের রক্ত আর কার্পাসের ভেতর ঘাপটি মেরে আছে সে। বারবার থুবড়ে পড়ছে আমাদের গান আর কলরব।
কৌটোর ভেতর থেকে গলা বাড়িয়ে
পরস্পরের নাম ধরে ডেকে উঠবার আগেই
সেই অদৃশ্য, কদমছাঁট-আততায়ীর
ক্রূর হাসির নিচে ঝরে পড়ছি আমরা
পত্রমোচী গাছের পাতার মতো
অন্তিম চুম্বনহীন, অবজ্ঞাত, একা আর নিঃসহায় !