একজন ইরফানের গল্প

338

উচ্চবংশীয় হিন্দু মেয়েটি, কোনোভাবেই নিজের মুসলিম প্রেমিককে সেদিন নিজের বৃদ্ধ হিন্দু পিতার সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাতে পারেনি সাহস করে। পিতা জানতে পেরেছিলেন নিজের মেয়ের এক ভিন্নধর্মী ছেলের সাথে সম্পর্কের কথা। স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তাকে বেছে নিতে হবে নিজের পরিবার কিংবা সম্পর্কের মধ্যে যে কোনো একটিকে। জীবনের কঠিনতম মুহূর্তে দাঁড়িয়েও সেদিন বছর তেইশের সুতপা বেছে নিয়েছিল নিজের প্রেমিকের হাতকে। পিতার পা ছুঁয়ে বেরিয়ে এসেছিল ঘর এবং কৈশোর ছেড়ে।

তৎকালীন মুম্বাইয়ে দুই হিন্দু-মুসলিম অবিবাহিত প্রেমিক যুগলের পক্ষে ঘর খুঁজে পাওয়া ছিল অসম্ভবের চেয়েও অধিক দুষ্কর। তবু নিজেদের এক বন্ধুর সাহায্যে মাত্র দুই-কামরার একটি ঘরে বসবাস শুরু করে তারা। সেখানে থাকাকালীন চলতে থাকে ছেলেটির অভিনয়ের প্রচেষ্টা এবং মেয়েটির লেখালেখি। বছর দুয়েকের মধ্যেই মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে পড়ে। নিমেষের মধ্যে যেন ঘটে যায় ছেলেটির মধ্যে এক অদ্ভুত রূপান্তর। শুধুমাত্র নিজের ভালোবাসার মানুষটি এবং নিজের সন্তানের ভবিষ্যতের স্বার্থে সেদিন ছেলেটির নিজের ধর্ম পরিবর্তন করতেও প্রস্তুত ছিল।

এরপর শুরু হয় ছেলেটির স্বপ্নের দৌড়। মাত্র তেইশ বছরের ব্যবধানে ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার উঠোন থেকে ছেলেটি পৌঁছে যায় পৃথিবীর বৃহত্তম মঞ্চ, একাডেমি এওয়ার্ডসের স্টেজে। তার ঝুলিতে তখন দুইখানা অস্কার নমিনেটেড মুভি, দুইখানা ফিল্মফেয়ার, একখানা পদ্মশ্রী এবং প্রায় পঞ্চাশের অধিক অভিনয় জগতের এবং জাতীয় স্তরের বিভিন্ন এওয়ার্ড। মুম্বাইয়ের অলিগলিতে নিজের পোর্টফোলিও হাতে ঘুরে বেড়ানো সুতপার সেদিনের সেই প্রেমিক তখন হয়ে উঠেছে ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীর সর্বাধিক আলোচিত এবং স্বীকৃত অভিনেতাদের মধ্যে একজন।

কিন্তু এরই মাঝে ছেলেটির শরীরে হঠাৎ করেই বাসা বাঁধে মারণ ক্যান্সার। নিজের যাবতীয় কাজ ফেলে মেয়েটি তাকে নিয়ে ছুটে যায় সুদূর লন্ডনে। দীর্ঘ এক বছরের চিকিৎসায় ছেলেটি সুস্থতার মুখ দেখলে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয় সারা দেশ। কিন্তু এর পর দেশে ফিরে পুনরায় অভিনয়ের কাজ শুরু হলে আবারও তাকে গ্রাস করতে থাকে অসুস্থতা। এবং এরপর গত বছর ২৯ এপ্রিল কাউকে কিচ্ছুটি না জানিয়ে মাত্র তিপান্ন বছর বয়সে নিজেদের বিবাহের পঁচিশ বছরের মাথায় ছেলেটি চিরতরের জন্যে পাড়ি দেয় কোনো এক অসীমের উদ্দেশ্যে। ফেলে রেখে যায় নিজের স্ত্রী-পরিবার, দুই পুত্র সন্তান, একশ তিরিশ কোটি মানুষের শোক ও মুগ্ধতা, নিজের অবিস্মরণীয় কিছু চরিত্র, অগুনতি সংলাপ, একখানা নিথর ভেন্টিলেটর ও এক অমর রূপকথা…

তবে ছেলেটি জানে যে তার অভিনয় এখানেই শেষ নয়। কোনো এক অন্য মহাকাশে এক অন্য নাটকের স্টেজে তাঁর সাথে ফের দেখা হবে মেয়েটির। মেয়েটির হাতে লেখা কাহিনী এবং ছেলেটির সাবলীল অভিনয় হয়তো দর্শকদের বিমুগ্ধ করে তুলবে আবারও। নাটক শেষে হাত ধরে স্টেজ থেকে নেমে আসবে তারা। ঘনিয়ে আসা পর্দা, তীব্র হাততালি এবং নিভে আসা স্টেজবাতির সাথে সাথে দর্শকাসন থেকে মেয়েটির কানে আবারও ভেসে আসবে তার সেই চিরপরিচিত চিৎকার… ‘ইরফান! ইরফান! ইরফান!’

কারণ এই ধরিত্রীতে আর কেউ না জানলেও ওই মেয়েটি ভীষণ স্পষ্টভাবে জানে যে কালের দোষে অভিনেতা, শিল্পী কিংবা প্রেমিকদের মৃত্যু হলেও এই পৃথিবীতে ‘ইরফান’-দের কখনো কোনো মৃত্যু হয় না।

অনি/সিনেটিভি