সময়ের মানুষ ও অসময়ের মানুষ

370

নজরুল ইশতিয়াক

অসময়ে কৃষি করে মিছামিছা খেটে মরে/ গাছ যদিও হয় বীজের জোরে তাতে ফল তো ধরে না। সাঁইজীর এই বাণীতে জীবন জন্মের একটি গভীর অন্বেষণ, গভীর তাৎপর্য লুকিয়ে রয়েছে। সেই গভীর সত্যটি উপলব্ধির প্রয়োজন সবার আগে। এটা সবাই জানি জীবন থেকে জীবন। মানুষ থেকে মানুষ। মানব বীজ থেকে মানবের জন্ম, আর সেই জন্ম নেয়া মানুষটিকেই যে প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে হয় তা তো স্পষ্ট।

শুধু কামনা কিংবা শারিরিক উত্তেজনা বশত নারী-পুরুষের দৈহিক মিলনহেতুই জন্ম হচ্ছে। এটি রকেট প্রযুক্তি নয়। নিছক প্রাকৃতিক যৌন উন্মাদনা। জন্ম নিয়ে শত সংস্কারের ঘেরাটপে, আরোপিত পরিচয় লব্ধ জীবন যেমন হয়, তেমনই হয়ে বেড়ে উঠছে। চালাকি প্রতারণা পূর্ণ সেই জীবনের বিরাট আয়োজন চলছে সব খানে।

বীজ থেকে জন্ম নেয়া মানুষ আর প্রকৃত মানুষ- সত্যমানুষ, দূরত্বটা তো লক্ষ যোজন। দৈহিক কাঠামোর মানুষ, সাদা, ফর্সা, লম্বা, চওড়া, গাল গল্পওয়ালা, দর্শনধারী, নাদুস নুদুস, বারবীডল টাইপের, এলিট এলিট, শিক্ষিত মানুষের বিরাট বাজার সম্প্রসারিত হয়ে আছে। সেই বাজারে এসে ভিড়ছে সব ধরনের পণ্য।

জন্মগত ভাবে দেহধারী মানুষ যে কেমন মানুষ, তাতো অদ্ভুত ভয়ংকর সব কৃতকর্ম দেখে বুঝতে সমস্যা হয় না। গাছমানুষ আর ফলবান মানুষ এক নয়? চণ্ডী দাসের ” সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই” কথাটি সত্য অন্বেষণের বিচারে সঠিক নয়। আবার ধর্ম স্বীকৃত ঘোষিত “আশরাফুল মাখলুকাত” কথাটিও সঠিক হয় না হয়ে কেবল কথার কথা হয়ে যায়। কিছু জোরালো শর্ত রয়েছে মানুষ হয়ে উঠার ক্ষেত্রে।

সময় গেলে সাধন হবে না। লালন ফকিরের একটি বাণীটি কথার কথা নয়। সময় বলতে বয়ে যাওয়া জীবন, সংসার বৃত্তের ঘোড়দৌড়, জগতের শিকল শৃঙ্খল ও পরিবর্তন বাস্তবতার গভীর সত্যের সংযোগ রয়েছে। এটা কোন সময় মানবজীবনের? এটিই তো দেখতে হবে সবার আগে।

সময়কে ধরতে না পারা, অসময়ের মানুষ তো চারপাশ ভরা। কোন কাজে লাগছে না বরং সীমাহীন ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে মানব জাতি। বিপদাপন্ন হয়ে উঠছে সব জায়গা। বসবাস অযোগ্য হয়ে পড়ছে সমাজ সংসার। শুধু কথা কথা আর কিছু বাকোয়াজী আলাপ। বাজারে গালগল্প, বীরত্ব, প্রসংশার মহামারী পণ্য। কোটেশন, কাটপিস, কপি-পেস্ট ধর্ম, গণতন্ত্র, টকশো, সেমিনার, গবেষণা। সবই বাণিজ্যিক কাজ। এসবই অসময়ের মানুষের কাজ। যারা জীবনের এই বেলা, এই সময়কে ধরতে পারেনি, সময়ের মানুষ হয়ে উঠেনি। এরা গালগল্প, গায়ের জোর, অর্থ বৃত্তে, পারিবারিক ক্ষমতায়, কুট কৌশলে পারদর্শী। এরা শিক্ষিত প্রভাবশালী, নিয়ন্ত্রক। এদের সত্য পরিচয় নেই। বাপের পরিচয় নেই। মায়েরে ভজিলে হয় তার বাপের ঠিকানা- সাঁইজী। মানহীন মেয়াদ উত্তীর্ন পণ্য।

সাঁইজী এদের কৃত কর্মের ফলাফলে শুধু এটুকু বলেছেন- মিছামিছি খেটে গেল। এরা জন্ম ও সময়ের সত্যটিকে ধারণ করতে পারেনি। পরম গতিশীল বর্তমানকে এরা উপলব্ধি করেনি। এরা যা করছে তা উদ্দেশ্য প্রণোদিত, প্রত্যাশার মোড়ক যুক্ত। এরা করছে লোক দেখানো কাজ। এসব কাজের কোন সুফল নেই। বরং চরম আঘাত অপেক্ষা করছে এদের ভাগ্যে।

জন্ম পথেই ফুলের ধব্জা ( পতাকা) ফুল ছাড়া নাই গুরু পুজা- লালন ফকির। এই জন্ম মাতৃগর্ভে নয়, গুরু গর্ভে। এ জন্য বলা যেতে পারে জন্ম এবং সৃষ্টি ভিন্ন। আবার মাতৃগর্ভ হয়েও সৃষ্টির একটি মহাধারা বিদ্যমান রয়েছে। এরা আসলে সত্য দেখেনি, উপলব্ধি করতে পারেনি। এদের আচরণে, একটু বেকায়দায় পড়লে ভিতরের রুক্ষ ক্ষত বের হয়ে পড়ে। আহা কত কুৎসিত কদাকার এদের ভিতরটা। এরা সাধনার জগতেও বাজারী বেশ্যা। বেশ ধারী হিসেবে বেশ্যা।

এরা সত্যকে ব্রত না করেই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে। এরা স্বরূপ হারা। সময়ের যাত্রা পথের মানুষ নয়। ফলে চরিত্রহীন আলেম যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে চরিত্রহীন কানা সাধু ও চরিত্রহীন দুনিয়াদার সমাজ সেবক, তথাকথিত মানুষ। যাদের বিকাশ সাধিত হয়নি অথচ গায়ের জোরে মিছামিছি নিজেদের প্রকৃত মানুষ হিসেবে নিজেদের দাঁড় করানোর বিরাট প্রচেষ্টা জারি রেখেছে। এদের দল ভারি। অর্থ ক্ষমতায় শক্তিশালী। এরা আল্লামা, মাওলানা, হাফেজ, যুক্তিবাদী, শায়েখ, হাদিসবাদীও। এমনকি ইতিহাসবাদী, ঐতিহ্যবাদী রুপেও পরিচয় দেয়। এদের সব কিছু ঠোটের উপর ভেসে বেড়ায়। গায়ের জোরে পাহাড় সরাতে বদ্ধ পরিকর এরা।

আলেম, ওলামা, পীরবাদে, সূফীবাদে! দেশপ্রেমিক সব জায়গায় এরা রয়েছে। ওয়াজের মাঠে সহজেই অসময়ের এই মানুষদের দেখা মেলে। তেমনি রাজনীতির মাঠে। রয়েছে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি, সাধনার অন্ধ চোরাগলিতেও।

অনি/সিনেটিভি