ঘেটুপুত্র কমলা, ঘেটুপুত্র বেদনা

335

পিয়াস মজিদ

হুমায়ূন আহমেদের অষ্টম ও শেষ চলচ্চিত্র ‘ঘেটুপুত্র কমলা’। এই মুভিতে লোকায়ত চর্চার এক লুপ্ত দিক সাংগীতিক বেদনায় ভাস্বর হয়েছে। মূলত হাওরাঞ্চলে বর্ষাকালে গৃহবিচ্ছিন্ন জলজীবনকালে জমিদারদের খেয়ালি ভোগবাসনার বলি হওয়া কিশোরের ব্যথাগাথা ‘ঘেটুপুত্র কমলা।’ নারীসঙ্গবঞ্চিত-কালে বিশেষ কিছু কিশোরদের নারীরূপ সৃষ্টি করে তাদের জমিদারদের অবসর-রঞ্জনের জন্য বিসর্জন দেয়ার অন্ধকার প্রথা এককালে প্রচলিত ছিল। হুমায়ূন সে কঠিন-করুণ সত্যকে মানবীয় রসায়নে পরিস্ফুট করেছেন।


চলচ্চিত্রকার হিসেবে তাঁর যে সর্বব্যাপ্তির গুণ অর্থাৎ সকল চরিত্রকে সমান গুরুত্বে উপস্থাপন-সেটা এই মুভিতেও লক্ষ্যযোগ্য। বদমেজাজি জমিদার, তার হতভাগিনী স্ত্রী, খেয়ালি শিল্পী, উচ্ছ্বল কিশোরী, খুনি গৃহকর্মী -সবাই সমান স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল।
জমিদারবাড়িতে খাবারের সুনির্বাচন যেমন অসাম্প্রদায়িক পরিবেশের ইঙ্গিতবহ তেমনি কোনো মানুষই যে শতভাগ নেতিবাচক নয়-সেই মানবীয় সত্যও ফুটে ওঠে জমিদারের শিল্পতৃষ্ঞা ও দু-একটি অনুষঙ্গে।
কিশোর কমলা তার অবুঝ সত্তা নিয়ে অসাধারণ ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে মুভি-জুড়ে। দুঃসহ দারিদ্র্যের দরুণ বাবা তাকে সজ্ঞানে ঘেটু-পেশায় নিক্ষেপ করেছে কিন্তু তার তো নিষ্পাপ কৈশোর কাটেনি তখনও। পরিচালক হুমায়ূন অদ্ভুত শিল্পকৌশল ও দক্ষতায় তার সঙ্গে জমিদারের সম্পর্কের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। সে তার অজান্তেই তার কৈশোর হারাল আর জমিদারপত্নী ও আরও অনেকের শত্রুর খাতায় নাম লেখাল।
বাড়ির আশ্রিত শিল্পী সব দেখে, করতে পারেনা কিছু। তবে তার অক্রিয় অবস্থার সক্রিয় প্রকাশ ঘটে ক্যানভাসে। আমার কাছে মনে হয় এই শিল্পীর চিত্রচর্চার ভেতরই মুভির মূল মর্ম নিহিত।
সে দেখে চলে, আশঙ্কায় থাকে। রক্তের পিচকারি কখন ছুটবে। জমিদারের ভোগবাসনা মিটতে থাকে, ঘেটুপুত্র কমলা নিঃশেষ হতে থাকে; পৃথিবীতে নিঃশেষ হতে হতে সে আকাশের বাসিন্দা হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
স্বপ্ন পূরণের প্রহর ঘনিয়ে আসে। জমিদারপত্নী তার পরিচারিকার সহযোগে ছাদ-পাঁচিল ধরে হাঁটতে থাকা কিশোর কমলাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। আকাশের স্বপ্ন দেখা ছেলেটা মাটিতে পড়ে যায়। তার রক্তের ধারায় ভেসে যায় চরাচর। ঘেটুপুত্র কমলার রক্ত যেন গাঢ় করে শিল্পীর পট; এতকাল এই রক্তের গন্ধই যেন সে পাচ্ছিল।
হুমায়ূন আহমেদ এই মুভিতে কোনো অতিনাটকীয়তার আশ্রয় নেননি। বরং সাধারণ এক লোক-ইতিহাসের সাবলীল উপস্থাপনে ক্ষমতার মদমত্ত মানুষের বিচিত্র প্রতাপে হারিয়ে যাওয়া নিচুতলার মানুষদের এক অধ্যায়কে নিদারুণ দরদে চলচ্চিত্রিক রূপ দিয়েছেন।
মুভি শেষ হয়ে আসে। ঘেটুপুত্র-সংস্কৃতির অবসানের কথা স্ক্রিনে ভাসে আর মৃদু বেদনার সঙ্গে বলা হয় ‘ঘেটু-গান’ নামে একটি সংগীত-ধারার হারিয়ে যাওয়ার কথা।
তবে হারায় তো না কিছু। গান ফুরোলে থেকে যায় গানের বেদন। ডাঙায় রক্তাক্ত-মৃত পড়ে থাকা ঘেটুপুত্র কমলার দুঃখে যেমন কাঁদে হাওরের জলবতী মন।

অনি/সিনেটিভি