বীথি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা

428

কালবেলা

(৬৬ বছর আগে খুব কষ্ট পেয়ে চলে গিয়েছিলেন জীবননান্দ দাশ।)

মেয়েকে একটা চিঠি লিখছেন জীবনানন্দ দাশ
কুয়াশার স্রোতে ভেসে গেছে তাঁর দিনরাত-বারোমাস।

‘চাকরি হারিয়ে বুঝেছি জীবনে টাকা কত দরকার;’
অভাবে অভাবে ভেঙে গেল তাঁর ধুলোমাখা সংসার।

বালির ওপর জ্যোৎস্নার মত প্রেম দূরে, বহুদূূরে —
কাজ খুঁজছেন তিনি সকলের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে।

শরীর ভালোনা, প্রেসিডেন্সির এত পড়াশোনা নিয়ে,
কিছুই হয়নি, সবকিছু হয় শুধু সুপারিশ দিয়ে…

মেয়েকে একটা চিঠি লিখছেন, বাড়ি ভাড়া বাকি আছে,
“সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে চাই নক্ষত্রের কাছে।”

এই শহরের বড় কবিদের ঈর্ষা কোথায় নামে?
তাঁর লেখা যেন চাপা পড়ে যায়, অনটন সংগ্রামে।

টাকার অভাব বদলে দিচ্ছে তাঁর মহাপৃথিবীকে,
অন্যের পাশে রোজই দ্যাখেন উচ্চাভিলাষী স্ত্রীকে।

তিনি কেউ নন এই পৃথিবীর, চাইছেন চলে যেতে,
যেভাবে রৌদ্র শুয়ে থাকে ওই ধানক্ষেতে মাথা পেতে।

মেয়েকে একটা চিঠি লিখছেন, অভাবে অভাবে ঢেকে,
খুব বেশি তিনি কখনও চাননি নিজের জীবন থেকে।

কিছুই পাননি, কুয়াশার দিকে চলে গিয়েছেন ধীরে,
পাখি হয়ে যদি ফিরতে পারেন ধানসিড়িটির তীরে।

মরণের আগে ইঁদুরের মুখে খুদকুড়ো লেগে থাকে,
অনেকেই খুব অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে তাঁকে।

হাঁটলে এখন যেন হাঁপ ধরে, শহরের রোদ্দুরে,
ইনসিওরেন্স পলিসি করান দরজায় ঘুরে ঘুরে।

কুয়াশার স্রোতে ভেসে যায় প্রেম, দিনরাত-বারোমাস,
মেয়েকে একটা চিঠি লিখছেন জীবননান্দ দাশ।

বিষাদসিন্ধু

পিঠ সোজা করে বাঁচতে চাইছে পূর্ব পাকিস্তান,
বাঙালির কাছে কুরবানী মানে মুজিবর রহমান।
খুব কম লোক থাকে দুনিয়ায় যাদের যাবেনা কেনা;
কী অত্যাচার করছে ওখানে ভয়াবহ খানসেনা…
প্রহরে প্রহরে রেডিও চলছে রাত হয়ে অাসে ফিকে
জরুরি মিটিং ডাকতে হয়েছে ইন্দিরা গান্ধীকে।
পোস্টার অার লিফলেট ওড়ে রবীন্দ্র নজরুলে,
মুজিবের ডাকে জনসমুদ্রে জোয়ার উঠল দুলে!
বাঁচবার মতো বাঁচব নাহলে কবুল করব প্রাণ;
বাঙালির কাছে কারবালা মানে মুজিবর রহমান।
কাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেল, পড়ে অাছে নদী পারে
নরম মাটিতে রক্তের রেখা ইচ্ছামতীর ধারে…
নদীজলে ক্ষীন অালো এসে পড়ে; মৃদু কুয়াশায় ম্লান
বাঙালির কাছে বিষাদসিন্ধু মুজিবর রহমান।

কবি ও পাঠক

গল্পগুচ্ছে জমে আছে বহু অনাদরভরা ধুলো ;
ঝরে পড়ে থাকে উদ্ধৃতি আর কাব্যগ্রন্থগুলো।

কলেকস্ট্রীটের ভিড়-কোলাহল ; প্রেসিডেন্সির গেটে
রবি ঠাকুরের পাতা উল্টোয়; ফুটপাত হেঁটে হেঁটে।

অনেক কিছুই ভুলে যেতে পারি শহরের পথে নেমে
হে কারুবাসনা, জীবন মরণ নিঃশেষ প্রেমে প্রেমে।

কী বলেছিলেন গীতাঞ্জলিতে আমাদের মনে থাকে?
কড়ি ও কোমল অন্ধকারের আড়ালে নিজেকে ঢাকে।

ফ্লাই ওভারের দিগন্ত ছুঁয়ে শহরের উচ্ছ্বাসে,
রবি ঠাকুরকে সত্যি ক-জন মন থেকে ভালবাসে?

দিনরাত্রি

হু হু করে কাটে দিনরাত
যেন ট্রেনের জানলা দিয়ে;
পেরিয়ে যাচ্ছে দিগন্তসীমা
ধানক্ষেত হাতে নিয়ে।

নিশুতি রাতটি ঝরে পড়ে
ঘোর বৃষ্টির মত মুখে
শুনসান পাড়া, ছায়ামূর্তিরা
হাঁটে শহরের বুকে।

পড়ন্ত রোদ মুছে দেয় দিন
পাখির ডানায় উড়ে,
কল্লোলিনীর কলরব যেন
বেড়াতে গিয়েছে দূরে।

কুসুমে কুসুমে ফাঁকা রাস্তায়
চরণচিহ্ন রেখে,
আর কতদূরে নিয়ে যাবে তুমি
আমাকে আমার থেকে?

কোনদিকে যাবো কিছুই জানিনা
কূল থেকে ঘোর জলে
নদীর ওপর জীবনের রং
কত খেলা বয়ে চলে।

ফাঁকা রাস্তায় ফুল ঝরে পড়ে
ধুলোবালি খড়কুটো;
তালা পড়ে গেছে দোকানে দোকানে
আলগা হাতের মুঠো।

দিন শেষ হয়ে যে সিন্ধুপারে
রোজ রাত এসে মেশে,
ছায়া মেখে কারা মিলিয়ে যাচ্ছে
না ফেরার দূর দেশে।

ফাঁকা রাস্তায় কুয়াশার স্তর
শহরের ধুলো মেখে,
আর কতদূরে নিয়ে যাবে তুমি
আমাকে আমার থেকে?