নজরুল ইশতিয়াক
বহুদূর দেখার আগে নিকটে দেখাটাই শ্রেয়। তাতে রোগ শনাক্ত করা যায়, সত্য ধরা পড়ে।
বিদ্যমান সমাজ কাঠামোর মধ্যেই রয়েছে প্রতিহিংসা, বর্বরতা, সংঘাত, সংঘর্ষ প্রতিক্রিয়ার বীজমন্ত্র। পুঞ্জিভূত রয়েছে তীব্র ক্ষোভ ও একে অপরকে নির্মূলের ঘাত অভিঘাত। পশ্চাৎপদ, বিপথগামী কিংবা কখনো কখনো অন্ধকারের শক্তি হিসেবে আমরা শক্তিকেই নানা নামে আখ্যায়িত করি।
নিজেদের সবা্থ সংশ্লিষ্ট অবস্থান থেকে এক পক্ষ আরেক পক্ষ কে দেখে নেয়ার প্রচ্ছন্ন হুমকী যেমন রাজনীতির মাঠে, বক্তৃতা, বিবৃতি, সংসদে, টকশতে দেখা যায়। তেমনি ওয়াজের মাঠে, তাফসির মাহফিলের নামে, মসজিদে খুৎবায় পযন্ত প্রকাশ্য চরম বৈপরীত্যের দেখা মেলে।
এক পক্ষ মুক্তিযুদ্ধকে বাজারজাত করে, আরেক পক্ষ বাজারে প্রবেশ করে ধর্ম ও বহুমাত্রিক ধর্ষণের ট্যাবলেট নিয়ে। দেশ সংবিধান, ৭১, কোন কিছুকেই তারা বিকৃত সস্তা করে তুলতে ছাড়ে না। বিভিন্ন সামাজিক ইস্যূগুলোতেও টার্গেট থাকে ধ্বংস করার, উপড়ে ফেলার।
বিশেষ করে নির্বাচনের মাসগুলোতে সংঘাত অনিবার্য হয়ে আসে। আর সারা বছরই পাড়া মহল্লায়, ঠিকাদারী চাদাবাজীতে, নানান অনুষঠানে তার মহড়া দেখা যায়। এসবই শক্তির বহুমাত্রিক খেলা। কখনো কখনো রাজনীতিকরা বলেও ফেলেন মাঠ সমতল করে তারপর খেলতে আসেন দেখা যাবে কার কত শক্তি।
শক্তিকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন শক্তি তো শক্তিই। মানুষ হিসেবে আমরা শক্তিকে যখনই যৌক্তিক সভ্য কাজে লাগাতে চায়, সমাজ গঠনে কাজে লাগাতে চায় , তখনই কেবল শক্তিকে সংযত পরিমার্জিত রূপ কিংবা একটা নিয়মতান্ত্রিকতায় ধাঁচে ফেলতে চায়। এটি সংস্কারের স্বাভাবিক ধারণা। এটিকে আমরা অগ্রগতি মূল্যবোধ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেখতে চায় সমাজটাকে।
নৈতিক অনৈতিক ট্যাগ লাগাই, আইনী-বেআইনী, ঈমানী কিংবা বেঈমানী কথার ম্যারপ্যাচে, কথামালা দিয়ে সমাজ বির্নিমানের চেষ্টা করি। নতুন নতুন আইন তৈরী ও নির্বাহী আদেশে কঠোর কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করে পরিস্থিতি মোকাবেলা করি, তখন সেটি সংঘাত সংস্কৃতি কে জিইয়ে রাখে ভবিষ্যতের জন্য।
‘ইট মারলে পাটকেলটি খেতে হয়’ প্রবাদের মতো সরল নয় সেই সংঘাত ব্যর্থ। গোষ্ঠীগত শক্তি, প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিকে কাজে লাগানো হয়। সমাজে অর্থনীতিতে কিংবা রাজনীতিতে নানান পক্ষ, নানান প্রতিযোগীতা, বৈষম্য রয়েছে। এটি থাকবেই।
প্রবাহমান সমাজকে আমরা কোন একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে, কোন একটি পক্ষভুক্ত অবস্থান থেকে কিংবা দৃষ্টি ভঙ্গিতে বিচার করি। এক কথায় কোন একটি মোড়ক বদ্ধ হয়ে। সমাজে রাজনীতিতে তো সবাই কম বেশি মোড়ানো। ফলে সুক্ষ্ম বিশ্লেষণের পরিবর্তে পক্ষপাতযুক্ত চোখে মূল্যায়ণ করা হয়। এটি হলো ছানিযুক্ত চোখে দেখার মতো। তবে চিন্তা মূল্যায়ণের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভয়াবহতর।
নিরপেক্ষতা বলে হয়তো কিছু না থাকলেও নির্লোভ মুক্তমনা জ্ঞাণবানরা অপেক্ষাকৃত সত্য কে তুলে ধরে। নানান বাস্তব কারণেই সৃষ্টি হয় ভয়াবহ সংঘাত।
বলা যেতে পারে পাওয়ার পলিটিক্সে সব কিছু চাহিদা ও যোগান নির্ভর। চাহিদা থাকলে সংঘাত সংঘর্ষের যোগান মিলবেই। অনেকটা উৎপাদনের কাঁচামালের মতো। এক্ষেত্রে
ধর্ম ও দারিদ্র্য হয়ে পড়ে তুরুপের তাস। সৃজনশীলতা, শিষ্টাচার, সুর কাব্য কলা নস্যি হয়ে যায়।
প্রেম ভালোবাসাও কেমন যেন উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে নিরাপত্তাহীনতায়, আহত পাখির মতো ডানা ঝাপটায়। করুন রোদনে তিলে তিলে মারা যায় কবি, শিল্পীর সুর, লেখকের চোখ। শিক্ষক ধর্মজীবী ও সব ধরনের চরিত্রহীনেরা এক কাতারে এসে দাঁড়ায়।
কিন্তু সময় পরিবেশ ও চাহিদা তো পরিবর্তন শীল। তাছাড়া গায়ের জোর, চোখের জোর, বুলেট চালানোর সক্ষমতাও তো চিরদিন থাকে না। পলেস্তারার মতো খসে পড়ে অনেক কিছু।
ক্ষমতার জোরে জোড়াতালি দিয়ে কেউ আজ জিতবে, কেউ জিতবে কালকে। লড়াইটা বাইরে যেমন ভিতরে ভিতরেও। উভয় পক্ষ আরো বহু গ্রুপের জন্ম দেয়। শক্তি সমরে অর্থে বিত্তে, রসদ সম্ভারে বহুমাত্রিক দূষণে দূষিত হয় সমাজ। কেউ জন্ম দেয় বাংলা ভাই, কেউবা অভি-নিরু, হাজারী বাজারী, শাহেদ, পাপিয়াদের। লম্বা হতে থাকে নষ্টের মিছিল।
যেহেতু রাজনীতির বিষয়। ক্ষমতায় থাকা কিংবা যাওয়ার বিষয় ফলে শিল্পকলা, উপাসনালয়, সবই বাজারের পণ্য। এগুলো বাজারে বিক্রি চলে। কখনো বাঙালি সংস্কৃতির নামে, কখনো বা কাল্পনিক বামপন্থী পণ্যের নামে, কখনো কখনো ওয়াজ মাহফিলের নামে, ধর্মীয় উন্মাদনার নামে।
সবই কেনা বেচা। ওয়ােজের বায়না জোটে মোটর লঞ্চ শ্রমিক সমিতি, বাজার সমিতি, যুবলীগের মহল্লার চাঁদাবাজ শেয়াল নেতারাদের কৃপায়! কোন কোন খ্যাতিমান যুদ্ধপরাধী জেলে থেকেও বাজার দখল রাখতে কাউকে কাউকে সমর্থণ দেয়। বন্দি কারাগারের অন্ধ কুটির থেকেও চলে বাণিজ্য বসতি।
প্রগতিশীল কোন কোন লুটেরা আল খেল্লা পরে দিন রাত ছবক দেয় অথচ রাতের বেলা কুকুর রাখে বিছানার সাথে বেধে। কারো প্রতি তার বিশ্বাস নেই। ব্যাংক লুট করে সেই টাকায় সেই ব্যাংকের শেয়ার কিনেও মালিক হয় কোন কোন লুটেরা দেশপ্রেমিক!
তাই তো গান ভেসে আসে “এ কোন সকাল রাতের চেয়ে অন্ধকার। “চাইলেও বহুতলা বেয়ে কোনমতে উপরে উঠে আর নিচে নামা যায় না।
নিচে নামলেই বাঘের ভয়। মগডালে বাসা বেধে জীবনের এই পরাজয় দৃশ্য, কত নিম্ন।
অনি/সিনেটিভি