নুসরাত সুলতানার গল্প ‘অপহরণ’

436

সকাল ৯.৩০। শায়লা রহমান নিম্মির রুমে যেয়ে দেখেন একদিকে জন কিটস আর অন্যদিকে সৈয়দ শামসুল হক আর বিনয় মজুমদার চারিদিকে ছড়ানো ছিটানো। পাশে চশমাটা রাখা হাতে মোবাইল। শায়লা যেয়ে নিম্মিকে ডাকতেই নিম্মি হুরমুড় করে উঠে জিজ্ঞেস করে,মা কটা বাজে? শায়লা বলেন ৯.৩০ মিনিট। ওহ মা তুমি আমাকে আগে ডাকবে না! ক্লাস তো দশটায়।এখন যেয়ে পাবো না। শায়লা বলেন উঠে নাস্তা করে নে। তাহলে আজ শপিং এ যাবো।

নিম্মির বয়স ১৯ নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স পড়ছে।টুকটাক লেখালেখি করে ফেসবুক ভিত্তিক শিল্প সাহিত্য গ্রুপ পোস্ট বক্সে। একই গ্রুপের দুর্দান্ত কবি,লেখক,প্রাবন্ধিক নাভিদ আহমেদ। প্রায় চারমাস ধরে প্রতিদিন ই নাভিদ আহমেদের সাথে নিম্মির মেসেঞ্জারে কথা হয়।ফোনেও কথা হয়।দুইদিন দেখা হয়েছে কফিশপে।
গতকাল সারারাত নাভিদ আহমেদের সাথে নিম্মি মেসেঞ্জারে কথা বলেছে।

নাস্তা সেরে শায়লা আর নিম্মি শপিং এ বের হয়।এর মধ্যে ফোন আসে বন্ধু জিহাদের। জিহাদ শিল্পপতির ছেলে। বেশ ভদ্র এবং ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন।শায়লা তাঁকে পছন্দ করে। জিহাদ দেখা করতে চলে আসে আলতামিরায়। আলতামিরা, অঞ্জন্স সব ঘুরে ঘুরে শপিং করে তাঁরা একটা চাইনিজ রেষ্টুরেন্টে বসে। শায়লা জানতে চান ফিনান্সে বি. বি. এ. শেষ করে জিহাদ কি করতে চায়। জিহাদ জানায় বিদেশে যাবে উচ্চশিক্ষার জন্য।শায়লা প্রসংসা করেন জিহাদের।খেতে খেতেই নিম্মি খোঁজ নেয় নাভিদ আহমেদের খেয়েছে কিনা,বাইরে কাজ আছে কিনা ইত্যাদি। কথায় কথায় নিম্মি জানায় তাঁর আজকে ক্লাস মিস হয়েছে।নাভিদ নিম্মিকে বকা দিয়ে বলেন যে বারোটার মধ্যে নেট অফ করে ঘুমাতে,আর যেন কখনও ক্লাস মিস না হয়।

পরের দিন ইউনিভার্সিটি ক্যান্টিনে জিহাদ জানায় নিম্মিকে, তাঁর রুচি,ব্যাক্তিত্ব এবং বাচনভঙ্গি জিহাদকে মুগ্ধ করে। নিম্মি হেসে বলে তুই আমার বন্ধু তুই তো আমাকে পছন্দ করবি ই। বিশেষভাবে বলছিস কেন? জিহাদ বলে ইচ্ছে হলো তাই বললাম। জিহাদ জিজ্ঞেস করে তোর চোখের নীচে কালি কেন? গতকাল রাত তিনটায় তোকে অনলাইনে দেখলাম কি করিস এত রাতে? নিম্মি হেসে বলে কিছু না।

নাভিদ আহমেদ এই পঁচিশ বছর এক চোখ নিয়ে চলছেন।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এল.এল.বি অনার্স পড়ার সময়ে চতুর্থ বর্ষে একসিডেন্টে একটি চোখ হারিয়ে ফেলেন। নিম্মি শুধু অবাক হয় নাভিদ আহমেদের মেধায়,মননে, লেখায়। নাভিদ নিম্মিকে কথায় কথায় জানায় গত দশ বছর ব্যাবসার কারণে লেখালেখি বন্ধ ছিল। এখন আবার লিখছে। নিম্মি বার বার নাভিদকে বলে এখন যেন লেখালেখি টা ঠিকভাবে করে।

নাভিদের সাথে নিম্মির প্রায়ই লেখালেখি নিয়ে কথা হয়। কথায়,কথায় নাভিদ আহমেদ নিম্মিকে জানায় তিনি অনুবাদ সাহিত্যে হাত দিয়েছেন। রুশ ছোট গল্প আর আইরিশ কবি টমাস মূরের কবিতা অনুবাদ করতে চান তিনি। কিন্তু ব্যাবসা,বাবা মায়ের অসুস্থতা আর পারিবারিক ঝামেলার কারনে করতে পারছেন না। নিম্মি বারবার অনুরোধ জানায়
নাভিদ যেন নিজের যত্ন নেন এবং সময়কে কাজে লাগান।

তৃতীয় বছরে জিহাদ আর নিম্মি। আজ জিহাদের জন্মদিন। নিম্মি একটা বেগুনি রঙের তাতের শাড়ি আর কালো টিপ পরেছে।জিহাদ বলে চল আজ একসাথে দুপুরের খাবার খাবো। নিম্মি বলে চল ভাত খাবো আলু ভর্তা, শরিষা ইলিশ, বেগুন ভাজি দিয়ে। দুজনে মিলে একটা দেশী রেস্তোরাঁয় বসে।নিম্মি জিহাদকে আকাশী নীল শার্ট আর প্রিয় কবি নাভিদ আহমেদের বই ” তবুও ভালবাসায় সিক্ত জীবন ” উপহার দেয়। জিহাদকে অনুরোধ করে তাঁর প্রিয় কবির একটা কবিতা আবৃতি করে শোনাতে। খাওয়া শেষ করে জিহাদ নিম্মিকে জিজ্ঞেস করে,নিম্মি আমাকে বিয়ে করবি? নিম্মি বলে কেন তোকে বিয়ে করবো এত ছেলে থাকতে! জিহাদ বলে,আমি তোকে সম্মান করি,পছন্দ করি,তোকে প্রাধান্য দেই সেজন্য করবি। নিম্মি বলে আচ্ছা প্রাধান্য দিস কিনা তার পরীক্ষা হবে
তারপর সিদ্ধান্ত জানাবে নিম্মি। জিহাদ বলে সে পরীক্ষায় বসতে চায়।

সময়ের স্রোত মহাকালের দিকে ধাবমান।নিম্মি, নাভিদ আহমেদের বন্ধুত্ব এক অদ্ভুত আলোয় আলোকিত। সেটা কেউ জানেনা। জিহাদ ও দিন দিন আরও ঝুঁকতে থাকে নিম্মির দিকে। চতুর্থ বছরের প্রথম সেমিষ্টার শেষ। নিম্মি একদিন জিহাদ কে ডেকে পাঠায়, বলে বিশেষ কথা আছে।
জিহাদ এলেএকটা শর্ত দেয় নিম্মি, বলে যে এটা করলে নিম্মি তাঁকে বিয়ে করবে।দুজনে অনেকক্ষণ পরামর্শ করে।

নিম্মি নাভিদ আহমেদকে বলে তারঁ সাথে বেষ্ট ফ্রেন্ডেকে পরিচয় করিয়ে দিতে চায়।তাঁরা সবাই মিলে তাঁর পূর্ব পুরুষদের জমিদার বাড়ি মানিকগঞ্জ যেতে চায়।নাভিদ আহমেদ বলে আচ্ছা। খুব সকালে যাত্রা শুরু করে নিম্মি,জিহাদ আর নাভিদ আহমেদ।নিম্মি নাভিদ আহমেদকে বাসায় ফোন করে বলতে বলে যে, সে দুই তিনদিন ঢাকার বাইরে থাকবে।অনেক জোরাজুরির পর নাভিদ আহমেদ বাসায় ফোন করে বলে দেয়।নিম্মি নাভিদ আহমেদের কাছে একটু ফোনটা দেখতে চায়।সীম কার্ডের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নিজের কাছে রাখে।
সে নাভিদ আহমেদ কে বলে এখানে আইরিশ কবি টমাস মূরের কবিতার বই আছে।এক সপ্তাহ জিহাদ থাকবে আপনার সাথে আর সমস্ত প্রয়োজন দেখবে। কিন্তু তাঁকে অনুবাদ শেষ করতে হবে। নাভিদ আহমেদ বুঝতে পারেন কোন কথায় কাজ হবে না।এই পাগল মেয়ের কাছে তিনি ফেসে গেছেন।

নিম্মি নিয়মিত জিহাদের কাছে সব খোঁজ খবর রেখেছে নাভিদের কোন সমস্যা হচ্ছে কি না।বার বার বলেছে তাঁর প্রিয় কবির খেয়াল রাখতে।এর মধ্যে নাভিদ আহমেদ জিহাদ কে অনুরোধ করে বাসায় একে দিন কথা বলছেন যে তিনি ভালো আছেন ফোন নষ্ট হয়ে গেছে তিনি শীঘ্রই ফিরবেন।এক সপ্তাহ হয়ে গেলে নিম্মি একদিন গাড়ি নিয়ে আসে। নাভিদ আহমেদ আর জিহাদ কে নিয়ে যেতে।নাভিদ আহমেদ গম্ভীর। নিম্মি বলে তাঁকে ক্ষমা করে দিতে।আর অনুবাদ গুলো তাঁকে দিতে সে টাইপ করে মেইল করে দিবে।অনুবাদ গুলো নিম্মির হাতে দিয়ে নাভিদ আহমেদ বাসায় চলে যান।

প্রকাশিত হয় আইরিশ কবি টমাস মূরের কবিতা আর রুশ ছোট গল্প বাংলা ভাষায়।
একুশে পদকে অনুবাদ সাহিত্যে নাভিদ আহমেদ একুশে পদক পান। নাভিদ আহমেদ নিম্মিকে ফোন দিয়ে বলেন নিম্মি এই পুরষ্কার তোমার।নিম্মির চোখে আনন্দাশ্রু।নাভিদ বলে নিম্মি তাঁর কাছে কি চায়?

নিম্মি বলে একদিন সে তাঁর প্রিয় কফিশপে নাভিদ আহমেদের সাথে দেখা করতে চায়।দিনক্ষণ ঠিক করে নাভিদ আহমেদ আসেন। তাঁরা একটা নির্জন কর্নারে বসে। নিম্মি নাভিদ আহমেদের প্রিয় ইটালিয়ান পাস্তা আর কফি অর্ডার করে। নিম্মি মোবাইলে ছেড়ে দেয় বব ডিলানের গান knocking on heavens door.চলে যাবার সময় হলে নিম্মি নাভিদের সামনে বসেই মোবাইলে মেসেজ দেয়” গিভ মি আ হাগ অ্যান্ড কিস অন মাই আইস প্লিজ” মেসেজ পেয়ে নাভিদ মনে মনে বলে এক্কেবারে ছেলেমানুষ মেয়েটা।ওঠার সময়ে এক ঝটকায় নাভিদ বুকে টেনে নেয় নিম্মিকে ঠোঁটে স্পর্শ করে নিম্মির চোখ।নিম্মি কেঁদে ফেলে।নাভিদ বলে চল তোমাকে পৌছে দিয়ে আসি।গাড়িতে নাভিদ নিম্মিকে একটা প্লাটিনাম লকেট উপহার দেয় আর নিম্মি দেয় অষ্টধাতুর আংটি। নিম্মি জানায় আর তিন মাস পরে জিহাদের সাথে তাঁর বিয়ে। নাভিদ নিম্মিকে জিজ্ঞেস করে সে ভালো থাকবে কিনা? নিম্মি বলে আমার মাথার একটা স্বচ্ছ আকাশ সবসময়ই থাকবে।ঘরে ক্লান্ত হলে আমি আকাশের নীচে এসে দাড়াবো।নাভিদ নিম্মি দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে চোখের ভাষা বুঝে নেয়।

বাসায় ফিরে নিম্মি কিছুক্ষণ একা একা বসে লালনগীতি শোনে।তারপর জিহাদকে ফোন দেয়।জিহাদ বলে, বল “প্রিয়তমা “। নিম্মি জানায় বিয়ের পরে প্রথমে সে কক্সবাজারে যেতে চায়। অনেক রাত অব্দি বীচে থাকবে জিহাদের কাঁধে মাথা রেখে সে জিহাদের কন্ঠে তার প্রিয় নাভিদ আহমেদের কবিতা শুনবে।ফোনের অপর প্রান্তে জিহাদ প্রশ্রয়ের হাসি দিয়ে বলে আমি নাভিদ আহমেদ মুখস্থ করে ফেলবো এই তিন মাসে।এবার নিম্মির মুখে ভুবন জয়ের হাসি!

অনি/সিনেটিভি