গৌতম মিত্র
গতকাল ১০/১২ জনের ‘ছাত্রদল’ নামের একটি গুগল টিমে জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে কিছু বলবার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলাম।তবে নাম ‘ছাত্রদল’ হলেও সেখানকার বেশিরভাগ সদস্যই অধ্যাপক ও স্ব স্ব ক্ষেত্রে গুণিজন।
সময় কম ছিল। কী বলি কী বলি ভাবতে ভাবতে ভাবনা নিজেই তার পথ দেখাল।কবিতা নিয়ে যেহেতু বলবার অনুরোধ ছিল তাই এমন করে ভাবতে ইচ্ছে হল।
জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়ে যে ক’টি আলোচনা আমি পড়েছি তার মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
শিবাজীবাবু নিজেই লিখেছেন, ১৯৮১-তে প্রকাশিত ‘প্রসঙ্গ জীবনানন্দ’ বইটিতে জীবনানন্দ দাশের যে কবিতাগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে তা ১৯৮১-তে প্রকাশিত ‘আলেপৃথিবী’ অবধির।
তাতে কবিতার সংখ্যা কত? ৪৩৮! অর্থাৎ শিবাজীবাবু যখন আলোচনা করছেন, প্রায় ২৫০০ কবিতা অগোচরে থেকে যাচ্ছে! আমি বলছি না ৩০০০ কবিতা নিয়ে আলোচনাই সফল আর আংশিক কবিতা নিয়ে আলোচনা ব্যর্থ।তবে এটা তো ঠিক, চোখের সামনে থাকলে, কাজে না লাগলেও, সেই কাজে না লাগা কবিতাগুলোও একভাবে আলোচনার ভারসাম্য রক্ষা করে। এতে কিন্তু শিবাজীবাবু বা তাঁর মতো অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, অমলেন্দু বসু, বীতশোক ভট্টাচার্য এমনকি বুদ্ধদেব বসু ও সঞ্জয় ভট্টাচার্যের দোষ নেই।আমি শুধু বলতে চাইছি, এই ২০২০ অবধি, জীবনানন্দ দাশের সব কবিতা আলোচনাই আংশিক।এবং আংশিক কবিতা নিয়েই।
অরুণকুমার সরকার জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছিলেন।
১.মনেময় জগৎ
২.কর্মময় জগৎ
৩.নবতর উৎসাহের মনোময় জগৎ
শিবাজীবাবু তাঁর তীক্ষ্ণ মেধা ও মনন দিয়ে এই পর্যায়গুলোকে ব্যাখ্যা করেছেন, প্রশ্ন তুলেছেন, এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আমি আর সেই আলোচনায় বিস্তারিত যাচ্ছি না।
তো আজ এই ২০২০- তে যখন আমার হাতে জীবনানন্দ দাশের প্রায় ৩০০০ কবিতা, কী দেখছি আমি! হাজার বিচ্ছুরণ তার, হাজার রূপকথা ও হাজার ভাঙাচোরা আয়না।
আমি শুধু সংক্ষেপে একটা কথা বলতে চাই।
জীবনানন্দের কাছে কবিতা ও জীবন এপিঠ ও ওপিঠ! জীবনানন্দের পরীক্ষাগারে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় গিনিপিগটির নাম শ্রীজীবনানন্দ দাশ! নিজেকে নিয়ে এত এক্সপেরিমেন্ট খুব কম কবিই করেছেন।
আমার মনে হয়েছে জীবনানন্দ দাশের যাত্রা তাঁর ‘আমি’-কে ‘অপর’ করে তোলার পথ ধরে।যেভাবে ‘কারুবাসনা’-র ফাস্টপার্সন কথক ‘মাল্যবান’-এ এসে ‘অপর’ হয়ে যায় বা ‘প্রেতিনীর রূপকথা’র আমি ‘সুতীর্থ’-এ এসে তুমি হয়ে ওঠে, ঠিক সেভাবে জীবনানন্দ দাশের কবিতার ‘আমি’ ক্রমশ দ্রুত সোমনাথ সেন, জোড়া হালদার, বিমল দালাল, চারু ঘোষাল, নিমাইচরণ,সান্যাল নামের ‘অপর’ বা জীবনানন্দেরই অলটার ইগো হয়ে উঠতে থাকে।
বোদল্যের ‘কেলাসিত আত্মন’ -এর কথা বলেছিলেন,নিটশে বলেছিলেন ‘farthest’ আমির কথা, র্যাঁবো বলেছিলেন ‘I is another’, কিয়ের্কেগার্দ বলেছিলেন হাসি ও কান্নার দুই মুখের কথা।রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন এ আমির আবরণ তাঁকে ঘিরে আছে।
জীবনানন্দ দাশের কবিতা এক (egoism) থেকে বহু(altruism) হওয়ার সাধনা।খুব সহজ নয় এই পথ।ধীরে ধীরে আমিত্বের মোড়ক খসাতে হবে।বর্জনের সেই পথ জটিলসুন্দর।সফলতা নয় নিষ্ফলতায় তাকে ছোঁয়া।
একদিন জলের মতো যে ঘুরেঘুরে একা কথা কয়েছিল আজ সে হেগেল বিক্রি করতে এসেছে।দড়ি হাতে একা একা যে যুবকটি গলায় ফাঁস দিতে গিয়েছিল আজ সে বগি-গাড়ি তমাল-তলায় সারারাত ভিজেছে একাকী।ক্রমশ প্রিন্টারের শয়তান, কাগজের সম্পাদক, স্ট্রেচার, বেলুন জগৎ, নিমাইয়ের ঘোড়া, মুদির বাটখারা, পাদটীকা ও ঘড়ির কাঁচ কবিতার জায়গা করে নিচ্ছে।
২০২০-তে এসে জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়ে কোনও আলোচনা করতে হলে এইসব কথা মনে রাখতে হবে।
স্কেচ : কৌশিক সরকার
ছবি : সুরজিৎ দাশগুপ্ত
অনি/সিনেটিভি