সুমন রহমান
২.
সাহিত্যিক ধনী কিংবা গরিব হওয়ার সাথে সাহিত্যের ধনী গরিব হওয়ার সম্পর্ক নাই। রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল, সুকুমার রায়, সুধীন্দ্রনাথ এরা প্রত্যেকেই যথেষ্ঠ ধনাঢ্য ছিলেন। উত্তরাধিকারসূত্রে। ব্যক্তিগত উপার্জনের মাধ্যমে হুমায়ুন আহমেদ, পাওলো কোয়েলহো, জে কে রাউলিং ধনবান হয়েছেন। পাবলো নেরুদা, অকটাভিও পাজ, এইমে সেজেয়ার, নিকোলাস গ্যিয়েন, লিওপোল্ড সেংঘর, আহমাদ সেকেতুরে, সৈয়দ শামসুল হক, শশী থারুর এরা যথেষ্ঠ ক্ষমতাবান ছিলেন/আছেন রাজনৈতিক ও সামাজিক অর্থে। এদের সাহিত্যকে কেউ বড়লোকের সাহিত্য বলে না। সাহিত্যের বিচারে, ধনী সুধীন্দ্রনাথ আর গরিব জীবনানন্দকে আমরা একবর্গেই রাখি। যেমন রাখি ধনী অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত আর গরিব বিনয় মজুমদারকে।
“আগস্ট আবছায়া”র লেখক মাসরুর আরেফিন সম্প্রতি কোনো সাক্ষাৎকারে বলেছেন: “যারা এসব বলেন তারা ওরাই যারা সাহিত্যকে সাহিত্যের বাইরের মাপকাঠি দিয়ে মাপতে চান—কাজী আনিস আহমেদকে না পড়েই এলিটিস্ট বলে খারিজ করতে চান, আমাকে কিংবা অনুবাদক ও গল্পকার ফারুক মঈনউদ্দিনকে ব্যাংক এমডি বলে উড়িয়ে দিতে চান, কবি ও নৃ-গবেষক কামাল চৌধুরীকে বড় আমলা বলে বাঁকা হাসি হাসতে চান।”
মাসরুর সম্পর্কে পরে বলছি, বাকি তিনজন সম্পর্কে বলি। কাজী আনিস আহমেদ, ফারুক মঈনউদ্দিন কিংবা কামাল চৌধুরী কখনোই তাঁদের ব্যক্তিগত/সামাজিক/রাজনৈতিক ক্ষমতা সাহিত্যিক প্রতিপত্তি অর্জনের জন্য ব্যবহার করেছেন — এমনটা শুনি নি। কাজী আনিস আহমেদ ঢাকায় একটা লিটারারি ফেস্টিভ্যালের সাথে যুক্ত আছেন অনেক বছর ধরে। কখনো দেখি নি সেখানে তাঁর নিজের লেখা সাহিত্য নিয়ে কোনো আলোচনা/সেশন হয়েছে। তার The World in My Hands উপন্যাস বেরিয়েছে ২০১৩ সালে। বাংলা অনুবাদ বেরিয়েছে ২০১৭ সালে। তেমন কোনো রিভিউ চোখে পড়ে নি। চাইলে তিনি নিশ্চয়ই ভুরি ভুরি করিয়ে নিতে পারতেন। ২০২০ সালে আমি এই বইয়ের রিভিউ করলাম, কারণ আমার বিচারে গত দশ বছরে বাংলাদেশের লেখকদের লেখা উপন্যাসগুলো মধ্যে এটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ। নানান কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সাহিত্যকর্ম।
ফারুক মঈনউদ্দিন যে বড় ব্যাংকার, সেটি মাসরুর না জানালে মনে হয় বুঝতেই পারতাম না। এমনি অন্তরাল পছন্দ করা একজন নিমগ্ন সাহিত্যিক তিনি। কামাল চৌধুরীও তাই। নিজের সাহিত্য নিয়ে কোথাও তাঁকে কোনো উচ্চকিত আওয়াজ দিতে শুনি নি। এরা প্রত্যেকেই সাহিত্য এবং সাহিত্যের বাইরের মানুষজনকে নানাভাবে সহায়তা করেন, কিন্তু সেই শব্দ কখনোই বাইরে পৌঁছায় না। যারা বিভিন্ন সময়ে তাঁদের কাছ থেকে সহায়তা পেয়েছেন, তাদের বরাতে ব্যক্তিগতভাবে আমি এটুক জেনেছি।
ফলে, মাসরুর আরেফিনকে এই বর্গে কল্পনা করাটা আমার জন্য কষ্টকর। তিনিও বহু মানুষকে সহায়তা দিয়েছেন মনে হয়। কিন্তু সেটি পাবলিকলি প্রচার করতে একেবারেই পিছপা নন। তাঁর বক্তব্য থেকেই জানলাম তিনি একজন কবিকে চাকরি দিয়েছেন, একজন লেখকের বই প্রকল্পে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা করছেন, একজন অনুষ্ঠান নির্মাতাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্পন্সর করছেন। কামাল চৌধুরী, ফারুক মঈনউদ্দিন কিংবা কাজী আনিস আহমেদরা এ ধরনের আলাপ পাবলিক পরিসরে কখনই করেন বলে শুনি নি।
একজন লেখক হিসেবে আমি সবচে কষ্ট পেয়েছি মাসরুর আরেফিন এর হাসান আজিজুল হক কাণ্ডে। আমাদের এই শীর্ষস্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠ সাহিত্যিককে নিয়ে তিনি যে কাণ্ডটি ঘটালেন সেটি আমার মত বহু সাহিত্যিক ও পাঠককে বেদনা ও লজ্জা দিয়েছে। হাসান আজিজুল হক এবং অন্যান্যদের টাকা দিয়ে বইয়ের ব্লার্ব লিখাতেই পারেন তিনি। তাতে সমস্যা নাই। কিন্তু হাসান আজিজুল হক যখন তাঁর নামে ছাপা হওয়ার বক্তব্য অস্বীকার করলেন, এবং মাসরুরের বইকে “বিদেশী সাহিত্যের বমন” জাতীয় অভিধা দিলেন, তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় মাসরুরের পোষা ভক্তকূল হা.আ.হককে নিয়ে যে ধরনের গুণ্ডাগার্দি করলেন, সেটা অবিশ্বাস্য। আরো অবিশ্বাস্য হল, পরবর্তীতে হাসান আজিজুল হক লিখিত ব্লার্বই দিলেন, মাসরুরের বইতে। অন্তরালে কী ধরনের তৎপরতা ঘটতে থাকলে এই বয়োজ্যেষ্ঠ লেখককে তাঁর বক্তব্য নিয়ে এমন ধকল পোহাতে হয়, সেটা অনুমান করা যায়। তাতে আমরা ভীত হয়েছি। বুঝতে পেরেছি যে, হাসান আজিজুল হকের মত মানুষেরই যদি এই দশা হয়, তবে আমাদের মত সামান্য লেখকদের গরিবি মর্যাদা যে কোনো সময়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারে এই আগ্রাসী পুঁজির তাণ্ডবে। (চলবে)
অনি/সিনেটিভি