মৃত্যু, মার্চ ও মায়া

290

কলকাতায় একবার চৌধুরী গেস্ট হাউস বলে একটা আবাসনে ছিলাম কয়েকদিন। অনেক পরে জানলাম ঋতুপর্ণ ঘোষের চিত্রনাট্যে সঞ্জয় নাগ পরিচালিত, ভারতীয় ইংরেজি মুভি ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’-এর কিছুটা শ্যুটিং হয়েছিল সেখানে। অন্য কোনো মুভি হলে এতটা শিহরণ জাগতো না যতটা ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’-এর নাম শুনে হল। কারণ মনের মঞ্চে ধীর লয়ে বেজেই চলেছে, চলেই চলেছে এই মুভির গান,
‘সখি হম মোহন অভিসারে জাউ
বোলো হম এতক সুখ কাহা পাউ’…
সুখের সাম্পানে বিধুর এক গল্পের চিত্রাভ উপস্থাপনায় অনন্য দীপ্তি নাভাল, রাইমা সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ এবং অবশ্যই মুভিতে অনুপস্থিত কিন্তু কণ্ঠ ও স্মৃতি-ভাস্বর মা আরতির প্রিয় সন্তান ‘বাবু’।
দূরের শহরে ছেলে চাকুরি করে। মনমতো অফিস। সেইসূত্রে পাওয়া ছিমছাম ফ্ল্যাট, গাড়ি আর মায়ের সেখানে এসে ছেলের সে সুখ চাক্ষুষ করার অপেক্ষা।
‘হাই মম’ বলে সম্বোধনটা এতই ভেতর-ছোঁয়া যে দর্শকের মনেই হবেনা এই চরিত্রটা মুভিতে অদৃশ্য। আর দৃশ্য কি শুধু তাই, যা আমরা স্বচক্ষে দেখি!
নয়তো মা যে ভেবে বসে আছেন, ছেলের জগত শুধু তাকে নিয়েই আর তার চিন্তানুযায়ীই কল্পনায় সাজিয়ে ফেলেছেন সন্তানের ভবিষ্যতের ছবি; তার দেখার সম্পূর্ণ আড়ালে বয়ে তো চলছিল ছেলের অন্যতর নদী। মা ও সমাজের ভাবনাবলয়ের বহু বহু দূরে তার নিজস্ব নদীর নির্মাণ চলছিল, বন্ধু অর্ণব নামের উজানের সঙ্গে। সে জলের ছপছপ শব্দগুচ্ছ মা পেলেন, তবে ছেলের প্রয়াণের পর।
মায়ের কাছে শ্মশাণে মৃত ছেলের সৎকারের চেয়ে কতটা দাহদায়ক, দূরের শহরে প্রথমবারের মতো ছেলের বাড়িতে আসা; যেখানে সে এক বিগত- নাম। বিমানযাত্রীদের এক একটা জীবিত গন্তব্য ছিল কিন্তু এখানে মা যখন জানে, তিনি যাচ্ছেন তার ‘বাবু’-র পানে, মৃত নক্ষত্রের সন্ধানে তখন তার আকাশে যেন আসন্ন সৎকারের ছাই এসে লাগে। গুমরে ওঠা কান্নার রঙে মিলেমিশে সে অবশ্য ধারণ করে শোকমাধুরীর বরণ; কারণ সড়ক দূর্ঘটনায় প্রাণ হারানো ছেলে চলে গিয়েও মাকে অদ্ভুত অথচ মায়াবী এক গল্পের মুখোমুখি করে। হয়তো বেঁচে থাকতে সে এই গল্পটা মাকে এত সহজে বলতে পারতো না। কিন্তু এখন, শামসুর রাহমানের ‘একটি ফটোগ্রাফ’ কবিতার ভাষায়-
‘কী সহজে হয়ে গেল বলা
কাঁপল না গলা…’
কিন্তু কম্পন তো ওঠেছিল মায়ের মনে। তার প্রথাশীল মন ও মনন প্রথমে মানতে তো পারে নি যে তার ছেলে সিদ্ধার্থের বলা ‘খুঁজে পাওয়া প্রাণের একজন’ তারই বন্ধু অর্ণব। অফিসে তার উর্ধ্বতন আর হৃদয়ে একই সমতলবাসী। মা মৃত ছেলের ঘরে তার প্রয়াত গন্ধ শুঁকে, অফিসে তার কাজের জায়গাটা ঘুরে দেখে, আর এক বন্ধু অপর্ণার সঙ্গে কথা বলে। তার কাছ থেকে কিছুকাল দূরে থাকা বাবু কি এতটাই দূরে চলে গিয়েছিল যে এখন সে তার ইচ্ছেমতো অবয়ব তৈরি করতে পারছে না!
আমরা প্রায়শই আমাদের কাছের মানুষদের নিজের ছাঁচে ফেলে ভাবতে সুখ বোধ করি কিন্তু সেই মানুষটার সুখ কিসে- সেটা কি ভেবে দেখি!
তবে জীবদ্দশার পুত্রের পত্র আর মৃত্যুর পর তার স্মৃতির রেখা মা-কে যেন সেই উপলব্ধির দিকে একটু একটু করে ধাবিত করে।
প্রথমে সে মানতেই পারে না তার ‘বাবু’-র একটা ‘অস্বাভাবিক সম্পর্ক’-এর সত্যতা, রীতিমতো বিরক্তিই ব্যক্ত করে প্রয়াত পুত্রের জীবিত ‘প্রিয়’ অর্ণবের প্রতি। আর এটাও মানতে অক্ষম জননী যে, মা ছাড়াও আর কেউ ছিল তার ছেলের, যার কাছে সে হৃদয় খুলে দিতো।
কিন্তু ধীরে ধীরে মা বুঝতে পারেন, ভালবাসার রং সোনালি, বাদামি কিংবা গোধূলি-সবই পারে হতে৷ মা তো ছিলেন না শুধু তিনি তার, বন্ধুও তো ছিলেন। বন্ধুর বেদনা তার প্রয়াণের পথ বেয়ে অনেক স্বছতার জন্ম দিয়ে চলে। অর্ণবের সঙ্গে কথোপকথনে তিনি তার সঙ্গে বিচ্ছিন্নকালীন ‘বাবু’-র মূতিটা ছুঁয়েছেনে দেখতে পারঙ্গম হন যেন।
এই মুভিতে কথার চেয়ে শক্তিমান কথার আভা। সিদ্ধার্থের দূর্ঘটনাস্থলে গাছের পাতা নড়া যেন মায়ের মনের রূপান্তরের রেখা।
যে সন্তানের জন্ম তার নাড়িছেঁড়া যন্ত্রণায় সেই সন্তানের মৃত্যুযন্ত্রণার সড়কে এসে মা তার প্রকৃত সত্তাসুন্দরকে মেনে নিতে পারার সৌন্দর্যে স্নাত হলেন যেন। কাছের মানুষ দূরে চলে যাওয়ার পর তাকে বুঝতে পারার যে বেদনাবোধ কতটা গভীর ও অপার তা এই মুভির দৃশ্য-অন্তিমে অরতির ( দীপ্তি নাভাল) চোখমুখের উদ্ভাসেও সুব্যক্ত। অর্ণব (ঋতুপর্ণ ঘোষ) আর তার ইতিউতি কথায়, রাতের নিকষ হাওয়ায় গানের বিজলি চমকায়। আর তখন মনে হতে থাকে, মনটাই সব। মেনে নিতে পারলে চেনা চোখের তিমিরও কী শোভাশীল!
ঘ্রাণ গ্রহণের সক্ষমতা থাকলেও মৃত্যুও কী জোরদার ঘোষণা করতে পারে ফুলের জন্মদিন।

পিয়াস মজিদ