‘গুলোবাে সিতাবো’ কিংবা পুতুলনাচের ইতিকথা

313

বহু আগে ‘পুরানা হাভেলি’ বলে একটা হিন্দি সিনেমা দেখেছিলাম। সেখানে হাভেলি বা পুরানো দালান ঘিরে ভৌতিক মচ্ছব ছিল মুখ্য আর জুহি চতুর্বেদির চিত্রনাট্যে সুজিত সরকারের সিনেমা ‘গুলাবো সিতাবো’-তে হাভেলির অনুষঙ্গে মুখ্যতা পায় মানুষের মনের ভেতর গজিয়ে ওঠা আলিশান ও একই সঙ্গে ধ্বংসকামী ভগ্নপ্রায় বাসনার প্রাসাদ।
‘গুলাবো’ আর ‘সিতাবো’ লক্ষ্মৌর ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাচের চরিত্র। এর রূপকে বাড়ির মালিক মির্জা, তার বেগম ফাতেমা ওরফে ফাতু কিংবা মির্জা বনাম তার বাড়ির ভাড়াটে -যে কাউকে প্রতিপক্ষতায় বসানো যায়। আবার সবায় তারা যেন এক বৃহৎ সুতো-সম্রাটের নাচানো পুতুল; যে যার ভূমিকায় অভিনয় করে যাচ্ছে শুধু। অমিতাভ বচ্চন আর আয়ুষ্মান খোরানার দুর্ধর্ষ অভিনয়ের চেয়েও বেশি শক্তিমান অভিনয়শিল্পী যেন খোদ ‘ফাতু মহল’ নামের সেই মহান ও অভিশপ্ত হাভেলি যা ছত্রখান করে দেয় সবাইকে, আবার কাউকে প্রায় শত বছর বয়সে নবজীবনও দান করে।
অমিতাভ ওরফে মির্জার মতো বাড়িপাগলা বুড়ো দেখে আমরা তাকে দূরগ্রহের কেউ ভাবতে পারি না কারণ ভাড়া-বাড়িতে থাকার বাস্তবতা যাদের আছে তারা সবাই এমন অনেক চরিত্রের দেখা পেয়েছি জীবনে। আর নিজেদের ক্ষয়িষ্ণু অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ভাড়াটিয়া-প্রয়াসের ভেতর তো প্রোথিত আমাদেরই পলকা সত্তা। সবই স্বাভাবিক। তবে অস্বাভাবিক হল মির্জার বেগম ফাতুর গতিবিধি। সিনেমার শেষাংশের আগপর্যন্ত বুড়ি এক অক্রিয় চরিত্র। সে দেখে তার বাপের দালান ঘিরে ঘরজামাই স্বামীর লোভের লকলকে অবয়ব। সে-ই বাড়িটা প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্যের কারণে হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে ভেবে স্বামীপ্রবর লুকোছাপা করে দালালের কাছে বিক্রির প্রক্রিয়াও শেষ করে। অসুস্থ বেগমের মৃত্যুসম্ভাবনায় স্বামী কাফনের কাপড় নিয়ে বাড়িতে ঢুকে দেখে বেগমসাহেবা এদ্দিন বিছানাবন্দি থেকে আজ খোলা হাওয়া খেতে বাইরে বেরুচ্ছেন। মির্জার বিস্ময়দৃষ্টি আর বেগমের টাঙ্গায় চড়ে বাইরে যাওয়ার শব্দ সিনেমার গতিই ঘুরিয়ে দেয়। এরপর হাভেলি ঘিরে মির্জা আর তার ভাড়াটেকুলের চালবাজির দফারফা হওয়ার দিন এসে উপস্থিত হয়। মির্জা গোপনে বাড়ি বিক্রির পাঁচ লাখ রুপাইয়ার সামনে হতবিহবল হতে না হতে হঠাৎ শুনে বেগমসাহেবা তার শয়তানির দফারফা করে দিয়েছে। এই বাড়ি ফাতেমার জন্মবাড়ি৷ এই বাড়িতে তাকে নিয়ে মির্জা থাকবে- শুধু এই সম্মোহনে যৌবনে তার আসল আশেককে শাদি না করে পারিবারিক পছন্দ মির্জার সাথে সংসার পেতেছিল।
হায়! বাড়ি!
পুরানা হাভেলি!
মির্জা যে আসলে ফাতুর প্রেমে বরং এই হাভেলির প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল সেটা বুঝতে তার একজীবন লেগে যায়। তবে বুড়ি হয়েও সে তার বাসনাকে জরাগ্রস্ত হতে দেয়নি৷ ডাক্তারের ছদ্মবেশে বাড়িতে উকিল আনিয়ে সে বহু আগেই বাড়িটি নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেয় তার সেই প্রকৃত প্রেমিকের কাছে যে এখনও তার অপেক্ষায় আছে৷ সেদিন টাঙ্গায় চড়ে ফাতু আসলে মরণ থেকে ওঠে জীবনের হাওয়া খেতে গেছে। বাড়িটা ফাতুর। মির্জা তার অগোচরে সই জাল করে বিক্রির আগেই ফাতেমা তাকে জীবনভর প্রাপ্য চড় কষেছে৷ মির্জাকে ফাতেমা ফকির করে নি; ফকির তো সে নিজের মনেই ছিল৷ তাকে বরং বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেয়ার সাথে সাথে শহরে একটা দুই কামরার থাকার ঘর দিয়ে গেছে।
হায় মির্জা, এই ছিল তোমার নসিবে!
তুমি এরপর চুপিচুপি এতকাল থেকে আসা হাভেলির সামনে গিয়ে দেখো ‘অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষেধ’। আর ভেতরে তোমার প্রাক্তন ফাতুর ৯৫-তম জন্মদিন ঘিরে কেক আর বেলুনের উৎসব। তুমি উৎসব-শেষে গাড়িতে বাইরে আসা ফাতুর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলে। ফাতু ফিরিয়ে তাকাল না। যেমন তুমি একজীবনে তার দিকে না তাকিয়ে তাকিয়েছ তার হাভেলির দিকে। তুমি হাভেলির দখল পেতে তোমার জীবিত বউয়ের কাফনের কাপড় খরিদ করে রেখেছ আর এখন সে নিজেই জিন্দা তোমাকে মুর্দা বানিয়ে দিল।
মির্জা, তোমার জন্য আমাদের কষ্ট হয়। যখন দেখি তুমি ফাতুর জন্মদিনের পার্টির বাইরে এসে পড়া একটা বেলুন হাতে লক্ষ্মৌর রাস্তায় কুঁজো হয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাও অন্ধকার গন্তব্যের দিকে৷ আরও কষ্ট হয় যখন দেখি, ফাতুর শেষ উপহার একটা সবুজ মখমলি রাজসিক চেয়ার তুমি জলের দরে বেচে দিলে বাজারে আর সিনেমার শেষ অভিঘাতে সেই চেয়ারটিকেই আমরা দেখি এক এন্টিকের দোকানে। বিক্রয়কর্মী তোমার কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে কেনা সে চেয়ারে লাখ টাকার ‘প্রাইস ট্যাগ’ লাগাচ্ছে নাকি তোমারই ধাপ্পা খাওয়া জীবনের মূল্য প্রদর্শন করছে পুতুলনাচের আসল সুতোর সম্রাটকে!

পিয়াস মজিদ