চলচ্চিত্রে নগ্নতা হচ্ছে কোনো একটি চলচ্চিত্রে কোনো মানুষকে নগ্ন উপস্থাপন করা, এই নগ্নতা হতে পারে সম্পূর্ণ বা আংশিক কাহিনী এবং পরিস্থিতির প্রয়োজনে। আধুনিক চলচ্চিত্রের জন্মলগ্ন থেকেই (‘৫০ এর দশক) কাহিনীর প্রয়োজনে নগ্নতা দেখানো হবে নাকি হবেনা এনিয়ে বিতর্ক চলে আসছে, তাছাড়া সংশ্লিষ্ট চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংযুক্ত যে অভিনেতা বা অভিনেত্রী ক্যামেরার সামেন নগ্ন হতে চান কিনা, এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আজ পর্যন্ত বহু অভিনেতা এবং অভিনেত্রী কাহিনীর প্রয়োজনে তাদের অভিনীত চলচ্চিত্রে নগ্ন হয়েছেন কখনো আংশিকভাবে বা কখনো সম্পূর্ণভাবে, আবার কখনোবা বডি-ডাবল (অন্য একজন মানুষকে) বা ডামি (নকল নগ্নতা) এর আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন।
একটি চলচ্চিত্রে যৌনতা বা গোসলের দৃশ্য বা কাপড় বদলানোর দৃশ্য দেখাতে গেলে পূর্ণ নগ্নতা দেখানোর প্রয়োজন পড়ে, কিন্তু যৌনাঙ্গ বা দৈহিক মিলনের দৃশ্য সত্যিকারভাবে দেখাতে গেলে সেটা পর্নোগ্রাফি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, তবে শুধু নিতম্ব দেখানো যেতে পারে। তবে আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে জননাঙ্গও দেখানো হতে পারে।
১৮৯৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি ফরাসি চলচ্চিত্রে নারীর নিতম্ব দেখানো হয়েছিলো। ঐ চলচ্চিত্রের কোনো সংলাপ ছিলো না অর্থাৎ নির্বাক ছিলো। জর্জ মেলেসের পরিচালনায় চলচ্চিত্রটির নাম ছিলো আফটার দ্যা বল। পরিচালক জর্জ মেলেসের ভবিষ্যৎ স্ত্রী ঐ চলচ্চিত্রে বডি-স্টকিং পরে নগ্নতাকে চিত্রায়িত করেছিলেন। ঐটি একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র ছিলো। উনবিংশ শতাব্দীতে ফরাসি আরো দুজন ব্যক্তি চলচ্চিত্রে নগ্নতা প্রদর্শনের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন; তাঁরা হলেন ইউগেন পিরো এবং আলবার্ট কির্শনার। আলবার্ট ইউগেনের চলচ্চিত্র পরিচালনা করে দিতেন (ইউগেন ছিলেন প্রযোজক)। ১৮৯৯ সালে তাদের একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে লুই উইলি নামের এক নারী গোসলখানায় কাপড় খোলার দৃশ্যে অভিনয় করেন। এইসব নগ্নতা সংবলিত চলচ্চিত্রগুলো ভালো ব্যবসা করতে পারত এবং তুমুল দর্শকপ্রিয়তা পেত বিধায় ফ্রান্সে নগ্ন চলচ্চিত্র নির্মাণের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল কয়েক বছরের মধ্যে।
অস্ট্রিয়াতে জোহান শোয়ার্জার (১৮৮০-১৯১৪) নামের এক ব্যক্তি ফরাসগ সিনেমাগুলোর স্বত্ব কিনে এনে তাঁর দেশে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছিলেন, পরে উনি নিজেই স্যাটার্ন ফিল্ম কোম্পানি নামের একটি প্রতিষ্ঠান খুলে অস্ট্রিয়ার নারীদের সম্পূর্ণ নগ্ন করে ফিল্ম বানানো শুরু করেন এবং ১৯০৬ সাল থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত ৫২টি নগ্ন চলচ্চিত্র তৈরি করেন। এই চলচ্চিত্রগুলো শুধু পুরুষদের জন্য উন্মুক্ত থিয়েটারে রাত্রের বেলা প্রদর্শিত হত। চলচ্চিত্রগুলো দর্শক মহল ভালোভাবেই নিয়েছিলো এবং ওগুলোকে শৈল্পিক কর্ম বলে আখ্যায়িত করতেন অনেকেই। ১৯১১ সালে স্যাটার্ন প্রতিষ্ঠানটিতে সরকার ধ্বংসলীলা চালায় অশ্লীলতার অজুহাতে এবং জোহান গ্রেফতার হন। যদিও জোহানের বানানো চলচ্চিত্রগুলো যাঁরা দেখতেন, তাদের অনেকেই গোপনে কয়েকটি চলচ্চিত্রের কপি নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছিলেন যা বহু পরে অস্ট্রীয় সরকারের চলচ্চিত্র সংরক্ষণ বিভাগ তাদের কাছে সংরক্ষিত করে রাখে সরকার ব্যবস্থা উদারবাদী হওয়ার পর। এমনি কয়েকটি চলচ্চিত্র হলো: ডাস সান্ডবাড (১৯০৬), বাডেন ভেরবোটেন (১৯০৬), ডাস এইটেল স্টুবেনম্যাডচেন (১৯০৮) এবং বেইম ফটোগ্রাফেন (১৯০৮)।
১৯১১ সালের ইতালীয় চলচ্চিত্র দান্তে’স ইনফার্নোতে–যেটি দান্তের ডিভাইন কমেডি থেকে কিছুটা অনুপ্রাণিত হয়েছিলো–নরকের কয়েকটি দৃশ্যে নগ্নতার অবতারণা করেছিলেন পরিচালক ফ্রান্সেসকো বার্তোলিনি। ১৯২৪ সালে চলচ্চিত্রটি যুক্তরাষ্ট্রে ইংরেজি ভাষায় পুনঃনির্মাণ করে একই নামে (দান্তে’স ইনফার্নো) মুক্তি দেওয়া হয় এবং ওটিতেও অনুরূপ নগ্নতা দেখানো হয়, এই চলচ্চিত্রটি ‘ফক্স ফিল্ম কর্পোরেশন’ প্রযোজনা করেছিলো।
যুক্তরাষ্ট্রে ১৯১৫ সালে ইন্সপাইরেশন নামের একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায় যেটিতে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করা এক নারী নগ্ন হয়েছিলেন, এটিই ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নগ্নতা প্রদর্শনকারী চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটিতে নগ্নতার বিষয় ছিলো এক চিত্রশিল্পীর জন্য নগ্ন হওয়া; কারণ তিনি নগ্ন ছবি আঁকবেন। অড্রি মান্সন নামের এক অভিনেত্রী চরিত্রটিতে অভিনয় করেন। ইনি আবার ১৯১৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত পিওরিটি নামের একটি চলচ্চিত্র অভিনয় করেন নগ্ন হয়ে, শুধু একটি স্থিরচিত্রে তাকে দেখানো হয়, নিতম্ব এবং স্তন দেখা যাচ্ছে এমন ছবি। অ্যানেট কেলারম্যান নামের এক অস্ট্রেলীয় নারী, যিনি ভালো সাঁতারু ছিলেন, ১৯১৬ সালের মার্কিন চলচ্চিত্র এ ডটার অফ দ্যা গড্স এ সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে অভিনয় করেন, কিন্তু তাঁর শরীর তার মাথার চুল দিয়ে ঢাকা ছিলো। এই কেলারম্যান ১৯১২ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন যা এখন আর পাওয়া যায় না। তিনি ওগুলোতে নগ্ন হয়েছিলেন নাকি হন নি, সেটিও জানা যায় না। তাঁর নিজের দেশ অস্ট্রেলিয়াতে তাঁর অভিনীত ১৯১০ সালের দুটি চলচ্চিত্র অনেক পরে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো।
ত্রিশের দশকে হলিউড সিনেমায় প্রচুর নগ্ন চলচ্চিত্র তৈরি হত তবে তা সবজায়গায় প্রদর্শনের অনুমতি ছিলোনা। ১৯৩৮ সালের চলচ্চিত্র চাইল্ড ব্রাইড এ অভিনেত্রী শার্লি মিলস (১৯২৬-২০১০) নগ্ন হয়েছিলেন মাত্র ১২ বছর বয়সে, চলচ্চিত্রটি সেন্সর বোর্ড কেটে-ছেটে মুক্তি দিয়েছিলো। ১৯৩৪ সালে ম্যানিয়াক নামের একটি চলচ্চিতে মুক্তি পায় যেটাতে কিছু নারীকে সম্পূর্ণ নগ্ন দেখানো হয়, এছাড়া সেক্স ম্যাডনেস (১৯৩৭) এবং মারিজুয়ানা (১৯৩৬) এ নগ্ন দৃশ্য ছিলো। ১৯৪১ সালের চলচ্চিত্র আউট ল এবং ‘৫৩ সালের দ্যা ফ্রেঞ্চ লাইন এ নগ্ন দৃশ্য রাখা হয়।
ষাটের দশকে হলিউড নগ্নতা দেখানোর ক্ষেত্রে পুরোপুরি বাঁধামুক্ত ছিলো এবং তখন থেকেই হলিউড নগ্নতার জগতে ভালো মতন প্রবেশ করে।
১৯৯০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হেনরি এ্যান্ড জুন’ চলচ্চিত্রটিতে অনেক নগ্ন দৃশ্য দেখানো হয়, এই চলচ্চিত্রটি ফ্রান্সে জন্মগ্রহণকারী মার্কিন লেখিকা এনাইস নিনের একটি ফরাসী বইয়ের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিলো যেটিতে নিন মার্কিন লেখক হেনরি মিলার এবং তার পত্নী জুনের সঙ্গে সম্পর্কের আলোকপাত করেছিলেন।
লেখকঃ গিরিস গৈরিক