বাংলাদেশে কি গান হওয়া থেমে গেছে নাকি আমি এক বিবরবাসী পাচ্ছি না শুনতে কিছুই ? কান পাতছি কিন্তু কোন সুর শুনতে পাচ্ছি না, যে সুর আমাকে ভাসিয়ে নেবে, কান পাতছি কিন্তু কোন কথা শুনতে পাচ্ছি না, যে কথা আমাকে ভাবিয়ে তুলবে !
মনে পড়ে আশির দশকের কথা যখন আমরা কলেজ ছাত্র, বাতাসে কান পাতলেই গান ভেসে আসতো, সে গান আমাদের শুধু শ্রবণেন্দ্রিয় নয়, আমাদের চিত্ত, আমাদের মননকে জাগিয়ে তুলত । শুধু সুর নয়, কথার চমকে আমাদের সব ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠত । তখন বাংলাদেশের চেয়ে ভারতীয় বাংলা গান আমাদের অধিক টানত । এর কারণ ছিল ভারতে বিশেষ করে পশ্চিম বাংলায় যে কালজয়ী শিল্পীর আবির্ভাব ঘটেছিল, এখন মনে হয় তা ছিল এক রেনেসাঁ । এক ঝাঁক শিল্পী বাংলা গানকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল যে এখনো তার গতি বহমান । শুধু কি শিল্পী, গীতিকবিরও জন্ম হয়েছিল দলবেঁধে । এর আগে ভারতীয় মার্গ সংগীত তার উৎকর্ষে আকাশ ছুঁয়েছে, বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে তার প্রভাব, তার সৌন্দর্য । এই মার্গ সংগীতের সব উপাদান আত্মসাৎ করে বাংলা সংগীত তার রুপ সাজিয়ে তুলেছে । শুধু মার্গ কেন, লোকসংগীতের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য বাংলা গান নির্মাণে তাদের সবকিছু নিয়ে এগিয়ে এসেছে । যেন অপেক্ষা করেছিল, সময় তাদের একসাথে বসিয়ে নির্মাণ করিয়ে নিচ্ছে কালজয়ী সব গান । সেই গান বাংগালীর সংস্কৃতিকে যেন একাই ঊর্ধ্বে তুলে ধরছে ।
গান যে একটি সামাজিক প্রপঞ্চ, অনেকেই সেটা দেখতে পায় না । গানকে মানুষ মনে করে শুধু বিনোদন । কিন্তু এর মধ্যে যে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিষয়গুলি স্বতঃস্ফূর্তভাবে উঠে আসে, খেয়াল করে দেখে না । আমরা যদি মন দিয়ে গান শুনি, বিশেষত লোক এবং গণসংগীতগুলি, দেখতে পাবো এর মধ্যে মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস বর্ণিত আছে । গানের কথা শুনেই বলে দিতে পারবো এটা কোন সময়ের গান । নীলকর চাষিরা যখন গান গেয়ে ওঠে, বুঝতে কষ্ট হয় না, এদের বিদ্রোহ কাদের বিরুদ্ধে এবং এটা কোন সময় । কৃষকদের মুখের গান মনে করিয়ে দেয় জোতদাররা বা জমিদারেরা কিভাবে তাদের শোষণ করে । প্রতিটি শ্রেণী পেশার মানুষ যেভাবে অত্যাচারিত হয়, শোষিত হয়, গানে সেসব মূর্ত হয়ে ওঠে । কেউ যখন কাস্তেতে শান দেয়ার কথা বলে, বুঝতে বাকি থাকে না যারা শোষক, এই গান তাদের বিরুদ্ধে । আবার যখন কারখানা ফেলে রাজপথে মিছিলে শরিক হয় মাথায় লাল ফিতা বেঁধে, বুঝে নিই এরা পুঁজিবাদী শোষকদের বিরুদ্ধে জানবাজী রাখতে এসেছে । তখন তাদের গানের ভাষা যায় বদলে । উৎপাদন ব্যবস্থার রুপ বদলে যাওয়ার সংগে গানের কথা এবং সুর বদলে যায় । অর্থাৎ গান স্ব স্ব শ্রেণীর সাংস্কৃতিক হাতিয়ার বা প্রকাশের মাধ্যম ।
আমরা পুঁজিবাদের সন্তান । পুঁজিবাদ মানেই ব্যক্তি, এখানে ব্যক্তি প্রধান হয়ে ওঠে । শ্রম বিক্রি করার অধিকার পায় মানুষ, একদল মানুষ শ্রম বিক্রি করে, একদল কেনে । দুদলই স্বাধীন মানুষ । তবে যখনি তারা উৎপাদন ব্যবস্থায় যুক্ত হয়, একটা সম্পর্ক রচিত হয়ে পড়ে । একদল শোষণ করে, একদম শোষিত হয় । কিন্তু তারা প্রত্যেকে হয়ে ওঠে ব্যক্তি মানুষ । যদিও শোষিত মানুষ সংঘ গড়ে শোষণের বিরুদ্ধে লড়তে, আবার শোষকরাও তাদের শক্তিশালী সংঘ গড়ে তোলে । চলে দ্বান্দ্বিক সহাবস্থান । পরস্পর মুখোমুখি কিন্তু কেউ কাউকে পরিত্যাগ করতে পারে না । এরা যখন গান বাঁধে, তখন ভাষা এবং সুর বদলে যায় । শোষিত শ্রেণীর গান শোষক শ্রেণীর গান থেকে আলাদা । আবার সেই কৃষকদের গানের ভাষা থেকেও এই গান আলাদা । তবে যেহেতু একই কালে বসবাস, একই সংগীতের উপাদান নিয়েও সুরের প্রকাশ ভিন্ন হয়ে পড়ে মানুষের সাথে মানুষের রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণে । কথা যায় বদলে । আমরা গান শুনলেই বুঝে নিতে পারি এটি কোন শ্রেণীর গান । এর সমান্তুরালে চলে লোকসংগীতের বিবর্তিত রুপের গান । এইসব গান শুনলেই বুঝতে পারি শ্রেণী হিসেবে এখনো তারা অগ্রগামী চিন্তার অধিকারী হতে পারেনি । এটা পুঁজির বিকাশের অসমসত্তাকেই প্রকাশ করে । বিকাশের যে স্তরে আমরা এখন অবস্থান করছি, গান শুনলে বুঝতে পারি, সে বিকাশ এখনো প্রাথমিক স্তরেই রয়ে গেছে ।
পুঁজিবাদী সমাজ মানেই একটা ছোট্ট দলের কাছে গরিষ্ঠ মানুষ জিম্মি হয়ে পড়া । ব্যবস্থাটাই এমন । পুঁজির কাছে হার মানতে থাকে মানুষ । নিজেদের যা কিছু ক্ষুদ্র সম্পদ, একে একে সব হারিয়ে তারা হয়ে পড়ে নিজের শ্রম বিক্রি করা শ্রমিকে, কাজ নেয় ঐ পুঁজিপতি শ্রেণীর গড়া কারখানায় । তাদের জীবন বন্দী হয়ে পড়ে । এই বন্দিত্ব ঘোচানর জন্য তারা গান বাঁধে, তাদের গানের ভাষা তাই শেকল ছেঁড়ার ভাষা । এই পুঁজিবাদ তাদের শোষণ টিকিয়ে রাখতে তৈরি করে একটা শ্রেণী, বলা যায় তৈরি হয়ে পড়ে আপনা আপনি, এরা মধ্যবিত্ত । এরা ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদ টিকিয়ে রাখার যাবতীয় শ্রম ব্যয় করে । এরা মুলত সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণী । এদের নিজস্ব দুঃখ বেদনা সুখ আছে । এরা সংঘবদ্ধ নয়, এরা ব্যক্তি হয়েই সমাজে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে । এরা শিল্প সাহিত্য করে, এরা গান বাঁধে, এদের গানের ভাষা তাই একদম স্বতন্ত্র । এদের গানে থাকে ব্যক্তিগত আবেগ । প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ ইত্যাদি মূর্ত হয়ে ওঠে । এই গানগুলিই আমরা শুনি । এই গান শুনেই আমরা বড় হয়ে উঠি । কিছু মধ্যবিত্ত আবার বুর্জোয়া ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামে নিজেদের জড়িত করে । এরা জড়িত হয়ে পড়ে রাজনীতিতে, এরা বিবিধ গণ সংগঠন গড়ে তোলে । এরা গান বাঁধে, এদের গানের ভাষা ভিন্ন, সুর ভিন্ন । এইসব গানে বিদ্রোহ থাকে । কিন্তু এইসব বিদ্রোহ শিল্পিত করতে গিয়ে ভাষা বদলে যায়, ভাষার প্রাথমিক তীক্ষ্ণতা কাটিয়ে পরিশীলিত হয়ে ওঠে । এরা হাতে তুলে নেয় গীটার, কণ্ঠে তোলে বিদ্রোহের সুর ।
পুঁজিবাদ মানেই ক্রমশ আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠা । প্রযুক্তির উদ্ভাবনে পৃথিবী ছোট হয়ে আসতে থাকে, ভিনদেশী সংস্কৃতির পরশ লাগে । তখন উঠতি যুবকেরা ভিন্ন এক সংগীতে মেতে ওঠে । এরা সংঘ গড়ে, এদের এই সংঘকে সংগীতের ভাষায় ব্যান্ড বলে । এরা বাংলা সংগীতের ধারায় নয়, বরং বিদেশী ধারায় বাংলায় আত্মসাৎ করতে চায় । স্বাধীনতার পর থেকে এই ধারা গজিয়ে উঠতে শুরু করে, ক্রমে এখন সেই ধারাটি একটি শক্ত জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে । আগেই বলেছি আশির দশক থেকে শুনে আসা মধ্যবিত্তের গানে আমরা মাতাল হয়েছি, ধীরে এই ব্যান্ড সংগীত আমাদের জনগণের বিশাল তরুণ অংশকে দখল করতে থাকে । ওদিকে লোকসংগীত তার নিজস্ব ধারায় সৃষ্টি হতে থাকে, তাদের শ্রোতা ভিন্ন, বলা যায় আমাদের মতো পুঁজিবাদের প্রাথমিক বিকাশের কালে এরাই সংখ্যায় বেশী । ৯০ এর দশক থেকে আমরা দেখতে পাই আমরা যে ভারতীয় গানে মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম এবং নিজের দেশের গানের দিকে তাকানো হয়নি, এবার তাকানোর পালা শুরু হয় । দেখতে পাই আমাদের সংগীত বিশেষত চলচিত্রের গান এক অনুপম সৃষ্টির আধার । অসংখ্য কালজয়ী গান সৃষ্টি করেছে এই চলচিত্র । পাশাপাশি দেশের গান তো ছিল, স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধ আমাদের উপহার দিয়েছে পৃথিবীর সেরা দেশাত্ববোধক গান । সারা বাংলাদেশ এইসব দেশের গানে ভেসে গিয়েছে । আমাদের জাতীয় দিনগুলি এইসব গানে এমন ভাবে ভরে থাকতো যে আমরা দেশের সংস্কৃতির প্রতি, ইতিহাসের প্রতি এক ধরণের দায়বদ্ধতা অনুভব করতাম । জাতীয় সংগীত সবার ঊর্ধ্বে আমাদের মননকে এক অসাধারণ উচ্চতায় নিয়ে যায় যতবার এই গান শুনি । এই সময় আমরা আমাদের গানগুলির ফিরে তাকালাম এবং সেগুলি আবার নতুন করে গাইতে শুরু করলাম । আমরা লক্ষ্য করলাম যখন নতুন কোনকিছু সৃষ্টি করতে হয়, তখন পিছন ফিরে তাকাতে হয় । নিজের যা কিছু সেদিকে তাকাতে হয় । এই নিজের দিকে তাকাতে গিয়ে দেখা গেল অসংখ্য রত্নরাজি সৃষ্টি হয়ে বসে আছে । তখন নতুন গান সৃষ্টির পাশাপাশি এই গানগুলিও গাইতে থাকে আমাদের শিল্পীরা । এইসময় মৌলিক গানের একটা স্বতন্ত্র ধারা যা চলচিত্রের গান থেকে আলাদা, তৈরি হয়ে গেছে । কালজয়ী অসংখ্য গীতিকার এবং শিল্পীর আবির্ভাব ঘটে গেছে । আমাদের সংগীত জগত যেন নতুন সৃষ্টির উন্মাদনায় কাঁপছে । আঞ্চলিক লোকসংগীতগুলি যার রচয়িতা এক একজন কালজয়ী সংগীতকার, বাউল, সেগুলিও এই আধুনিক মধ্যবিত্ত সমাজের কাছে আসতে শুরু করেছে এবং সেগুলি জাতীয়ভাবে প্রচার হচ্ছে । শুধু বলতে পারি এই দেশে মার্গ সংগীতের ধারাটি আজো সেভাবে গড়ে ওঠেনি । এখানে আমাদের হাত পাততে হয় ভারতের কাছে । ফলে সংগীতের যে ব্যক্তিত্ব সেটা শক্ত কাঠামোর উপর দাঁড়াতে খুব একটা পারেনি । তথাপি আশির দশক থেকে শুরু করে প্রায় তিন দশক আমরা অসাধারণ এক সংগীত জগত নির্মাণে ডুবে ছিলাম এবং নির্দ্বিধায় বলতে পারি ঋদ্ধ সে জগত ।
সেই কাল যেন গত হয়েছে । যেন সৃষ্টির উন্মাদনা থেমে গেছে । বাতাসে কান পাতলে শুনতে পাইনা আর সেই মাতাল করা সুর, চেতনা বিদ্ধ করার মতো কথা । প্রযুক্তির কল্যাণে সারা পৃথিবীর গান এখন আমাদের হাতের মুঠোয় । কি দেখি সেখানে ? আমাদের গান কি আদৌ আন্তর্জাতিক মানের ? আমাদের লোকসংগীত ছাড়া সংগীতের আর কি কোন ধারা শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারার যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে ? গান প্রতিদিন হচ্ছে, কিন্তু তা যেন জাতির শ্রবণযন্ত্রকে ছুঁয়ে যেতে পারছে না । যেন বুদবুদ তুলেই মিলিয়ে যাচ্ছে । বরং দেখতে পাচ্ছি কিছু কর্পোরেট যারা গানকে পণ্য হিসেবে বাজারে নিয়ে আসছে, সেসব গান পুরনো, নতুন করে নির্মাণ করা হচ্ছে, নতুন গান প্রায় নেই । বিবিধ বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে এইসব গান বাজারে আসছে । যদিও সেসবের স্বাদ কিছুটা হলেও আমাদের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে কিন্তু নতুন গানের যে চমক, যে উন্মাদনা তা অনুভব করতে পারছি না ।
হয়তো আবার একটা কাল এসেছে যখন সৃষ্টি হয় না, একটা বন্ধ্যা কাল চলছে কিংবা হয়তো আমরা সত্যিকারের গান হচ্ছে কিন্তু সময় ব্যস্ততা আমাদের সেসবের কাছে নিয়ে যেতে পারছে না । তবে এটা তো ঠিক সৃষ্টি যদি বেদনা জাগাবার মতো শক্তিশালী হয়, জাগতে হবেই ।
লেখকঃ আহসান হাবীব